অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের খাবারের মান নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন তোলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ বার সরেজমিন তদন্তে গিয়ে তাজ্জব বনে গেলেন খোদ বিডিও। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মীদের কাছ থেকে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহকারী এবং ব্লক সুসংহত শিশুবিকাশ প্রকল্প আধিকারিক (সিডিপিও)-এর বিরুদ্ধে জোর করে দিনের পর দিন নিম্নমানের খাদ্যশস্য ব্যবহার করতে বাধ্য করার অভিযোগও শুনলেন নিজের কানে। গুদামে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া উন্নত মানের চালের পরিবর্তে বাজার চলতি নিম্নমানের চাল মজুত থাকতেও দেখলেন।
ঘটনাটি ঘটেছে রাইপুর ব্লকের শ্যামসুন্দরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের রামচন্দ্রপুর সবরপাড়া এলাকার একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে। মঙ্গলবার সকালে ওই কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলেন রাইপুরের বিডিও দীপঙ্কর দাস। আর বুধবার রাতেই খাদ্য সরবরাহকারী শৈলেন গঙ্গোপাধ্যায়, রাইপুরের সিডিপিও সিমসন মুর্মু এবং গুদামের স্টোর কিপার নুরুল আজিমের বিরুদ্ধে রাইপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন বিডিও।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ ওই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গিয়ে বিডিও দেখেন, সেখানে রান্না চলছে। কেন্দ্রে মজুত মুসুর ডাল দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। বিডিও-র কথায়, “যে মানের মুসুর ডাল মজুত ছিল, তা পশুরও খাওয়ার যোগ্য নয়! পোকা লেগে ডাল নষ্ট হয়ে গিয়েছে।” গর্ভবতী মা ও শিশুদের এই খাবার দেওয়া হচ্ছে কেন, অঙ্গনওয়াড়ির কর্মীদের কাছে তা জানতে চান বিডিও। এই ঘটনার জন্য খাদ্যদ্রব্য সরবরাহকারী এবং সিডিপিও-র দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন কর্মীরা। বিডিও বলেন, “খাদ্যদ্রব্য সরবরাহকারী ও সিডিপিও নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য ব্যবহার করতে কর্মীদের বাধ্য করছেন বলে আমাকে জানান কেন্দ্রের কর্মীরা।” এর পরেই ব্লক সিডিপিও-কে ডেকে পাঠানো হয় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে। এই সব ঘটনার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। ওই কেন্দ্রে মজুত দু’বস্তা মুসুর ডাল বাজেয়াপ্ত করেন বিডিও।
এর পরে পুলিশ নিয়ে বিডিও পৌঁছন রাইপুরের সবুজ বাজারে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের গুদামে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, গুদামে বিডিও ঢুকতে গেলে খাদ্য সরবরাহকারী শৈলেনবাবু তাঁর পথ আটকান। বিডিও-কে বলা হয়, চাবি নেই তাই গুদাম খোলা যাবে না। এমনকী, ফিরে যেতেও বলা হয় বিডিওকে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাবি না খুললে চাবি ভেঙে ভিতরে ঢোকার হুঁশিয়ারি দেন বিডিও। এই কড়া দাওয়াইয়ে কাজ হয়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই চাবি নিয়ে এসে গুদামের দরজা খুলে দেন শৈলেনবাবু। চাবি থাকার কথা স্টোর কিপার নুরুল আজিমের কাছে। খাদ্য সরবরাহকারীর কাছে ওই চাবি থাকে কী করে, প্রশ্ন তোলেন বিডিও। সদুত্তর পাননি নুরুল আজিমের কাছ থেকে। গুদামের ভিতরে ঢুকে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় বিডিও-র। তাঁর কথায়, “অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে চাল পাঠায়, তার বদলে নিম্নমানের চাল মজুত রয়েছে গুদামে। মজুত দ্রব্যের হিসেবেও রয়েছে গরমিল। সঠিক হিসেব দেখাতে পারেননি খাদ্য সরবরাহকারী বা সিডিপিও।”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, অভিযুক্ত খাদ্য সরবরাহকারী দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে দক্ষিণ বাঁকুড়ার খাতড়া, রানিবাঁধ, সিমলাপাল, সারেঙ্গা, তালড্যাংরা এবং রাইপুর ব্লকের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে খাদ্যশস্য সরবরাহ করে আসছেন। তাঁর পাঠানো খাদ্যের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অনেক বার। জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, “রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে শৈলেনবাবুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠলেও প্রশাসন এত দিন কিছু করে উঠতে পারেনি।”
তবে, মঙ্গলবারের ঘটনার খবর কানে গিয়েছে রাজ্যের শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, “এই ঘটনা বরদাস্ত করা যাবে না। মা ও শিশুদের খাবার নিয়ে ছেলেখেলা সহ্য করব না! দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে বলেছি।” এ দিন বারবার চেষ্টা করেও রাইপুরের সিডিপিও বা ওই গুদামের স্টোর কিপারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। অভিযুক্ত খাদ্য সরবরাহকারী শৈলেনবাবুর অবশ্য দাবি, “আমি নির্দোষ। গুদামে মালের হিসেবে কোনও গরমিল নেই।” তা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো চাল গেল কোথায়? তাঁর উত্তর, “সবই ঠিক আছে। যেখানে যা দেওয়ার কথা, সেখানে তা দিয়েছি।”
বিডিও দীপঙ্কর দাস বুধবার বলেন, “ওই তিন জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। সিডিপিও এবং স্টোর-কিপার সরকারি কর্মচারী হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও শুরু হয়েছে।” |