বুক ভরে নির্মল বাতাস টানার তাগিদে শহর ছেড়ে দূরে পাড়ি দেওয়ার দিন গিয়েছে। রাজ্যের দূষণ-মানচিত্রে বৃহত্তর কলকাতার পাশাপাশি জায়গা করে নিচ্ছে গ্রাম-গঞ্জ, মফস্সলও।
আর এ জন্য মূলত প্রশাসনিক গাফিলতির দিকেই আঙুল তুলছেন বিজ্ঞানী-পরিবেশবিদেরা। তাঁদের অভিযোগ, পরিবেশ দফতরের চাপে শহরাঞ্চলে দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প-কারখানায় কিছুটা লাগাম পরানো গেলেও নজরদারির অভাবে গ্রাম-মফস্সলে তা দিব্যি চলছে। ফলে দিন দিন বিষাক্ত হয়ে উঠছে সেখানকার পরিমণ্ডলও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) যখন বায়ু-দূষণকে ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তখন গ্রামবাংলার এ হেন দূষণ-চিত্রের প্রেক্ষাপটে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পরিবেশ দফতরের ভূমিকা পড়ে গিয়েছে বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে।
পরিবেশ দফতরের খবর: মহানগরের পরিবেশ রক্ষায় যাবতীয় শিল্প-কারখানাকে দূষণ সৃষ্টির নিরিখে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। লাল, কমলা ও সবুজ। লাল তালিকার শিল্পে দূষণ হয় সর্বাধিক, কমলায় তার চেয়ে কম, সবচেয়ে কম সবুজ তালিকার শিল্পে। ১৯৯৮-এর অবস্থান-নীতি (সাইটিং পলিসি) মোতাবেক, কলকাতা মেট্রোপলিটন এলাকায় লাল ও কমলা তালিকাভুক্ত শিল্প করা যাবে না। গড়া যাবে শুধু নিরাপদ ‘সবুজ’ শিল্প।
এতে কলকাতা কিছু রেহাই পেলেও বিপদ ঘনিয়েছে জেলায়। কারণ, সরকারি নিষেধাজ্ঞার জেরে লাল-কমলা বহু শিল্প কলকাতার পাট গুটিয়ে আধা শহর-গ্রাম-মফস্সলে চলে গিয়েছে। পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, এটা বেআইনি নয়। কিন্তু ওই সব কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের তেমন নজরদারি না-থাকাটাই কাল হয়েছে। ঢিলেমির সুযোগে বহু জায়গায় দূষণরোধক ব্যবস্থা ছাড়াই শিল্প চলছে রমরমিয়ে। যেমন, স্পঞ্জ আয়রন কারখানা, পাথর খাদান ও পাথর ক্রাশার থেকে ক্রমাগত দূষণ হচ্ছে। ‘কাটা তেলের’ অটো ও ভ্যানো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে। গজিয়ে উঠছে ইটভাটা। এমন নানা দৃষ্টান্ত রয়েছে। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, “কলকাতায় কতটা দূষণ কমানো গিয়েছে, জানি না। এটুকু জানি যে, গ্রামে-গ্রামে দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে।”
এবং তাতে স্বাস্থ্য হানির আশঙ্কা তো থাকছেই, চাষবাসেরও সমূহ ক্ষতিসাধন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, এ ক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি দায়ী স্পঞ্জ আয়রন কারখানা, গত ক’বছরে বর্ধমান-পশ্চিম মেদিনীপুর-বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে কার্যত যার ঢল নেমেছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য ল’অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দাপটে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ছে। এতে শ্বাস নালি ও ফুসফুসের রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, মার খাচ্ছে মাঠের ফসল। সবুজ ঘাস ঢেকে যাচ্ছে কালো গুঁড়োর আস্তরণে। সেই ঘাস খেয়ে গবাদি পশুও বিপন্ন।” ঘটনা হল, বছর কয়েক আগে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় রাশ টানতে চেয়েছিল। নজরদারি চালানোর লক্ষ্যে তৈরি হয় উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রও। কিন্তু এখনও তা কাজে লাগানো হয়নি।
কম যায় না ইটভাটাও। রাজ্যের এক পরিবেশ-বিজ্ঞানী জানান, ইটভাটা গজিয়ে উঠেছে যে সব জায়গায়, সেখানে আম-ধানের ফলন মার খেয়েছে। বছর কয়েক আগে এক বার নির্দেশ জারি হয়েছিল, আমের মুকুল আসার সময়ে ইটের উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে। নির্দেশটি অবশ্য এখন কার্যকর নেই। পাশাপাশি কলকাতায় বাতিল হয়ে যাওয়া কাটা তেলের অটোরিকশা হইহই করে চলছে গ্রাম-মফস্সলে। কাটা তেলের মোটরচালিত ভ্যান-রিকশা বা ‘ভ্যানো’ তো এই মুহূর্তে গ্রামাঞ্চলে গণ পরিবহণের অন্যতম মাধ্যম! পরিবেশবিদদের হাজারো আপত্তি সত্ত্বেও সরকার ওই ‘দূষণ-যান’টিকে বৈধতা দিতে চলেছে।
স্পঞ্জ আয়রন-ইটভাটা-অটো-ভ্যানোর সঙ্গে গ্রামীণ দূষণের অংশীদারি-তালিকায় মুড়িকল-ধানকলের মতো ক্ষুদ্রশিল্পও হাজির। পরিবেশবিদেরা জানিয়েছেন, ইদানীং বহু গ্রামের বাড়িতে-বাড়িতে মুড়িভাজার কারখানা গজিয়ে উঠছে। সেখানে ডিজেলের বড় বড় স্টোভ এবং উচ্চ ক্ষমতার জেনারেটর চলছে অবাধে, যার ধোঁয়া কলুষিত করে তুলছে পরিবেশ। বিধি অনুযায়ী, ১০ কিলোভোল্টের বেশি ক্ষমতার জেনারেটর ব্যবহার করতে গেলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র লাগে। মুড়িকলের মালিকেরা তার তোয়াক্কা করছেন না বলে অভিযোগ।
সব মিলিয়ে গ্রামের সবুজে দূষণের ছোপ চোখে পড়ার মতো। অজ গ্রামের বাতাসও বিষিয়ে উঠছে। এক পরিবেশ-বিজ্ঞানীর দাবি, ভাসমান ধূলিকণা বা বিষাক্ত গ্যাস হাওয়ায় ভর করে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে শহরের দূষণ যেমন গ্রামে পৌঁছে যায়, তেমন উল্টোটাও হওয়া স্বাভাবিক। পরিবেশ-কর্তাদের একাংশও প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন যে, গ্রামের দিকে সে ভাবে লক্ষ্য রাখা হয় না। “জেলাগুলোয় তো দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পরিকাঠামো সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই নজরদারিতে ঘাটতি স্বাভাবিক।” মন্তব্য করেছেন পরিবেশ দফতরের এক সূত্র। পর্ষদের ওয়েবসাইটেও সব জেলার দূষণ-তথ্য মজুত নেই বলে পরিবেশবিদ মহলের অভিযোগ।
অতএব, স্বাস্থ্য ফেরাতে গ্রামে যাওয়ার পরামর্শ আপাতত শিকেয় তোলা থাকছে। |