রাত বাড়লে আতঙ্ক চেপে বসে সরস্বতীদেবীর। বয়সের গাছ-পাথর নেই। চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ। তবে বুঝতে পারেন পায়ের নীচ থেকে মাটি ক্রমশই সরছে। ফাটল ধরছে এক চিলতে ঘরে। যার একদিক হেলে পড়েছে গঙ্গার দিকে। যে কোনও দিন ঘর ধ্বসে যাওয়ার দিন গুনছেন বৃদ্ধা। বললেন, “জোয়ার হলে বা খুব বৃষ্টিতে নদীতে জলের গতি বাড়লে টের পাই বাড়ির তলা থেকে একটু একটু মাটি সরছে। রাতের ঘুম চলে গিয়েছে আসে না। ভয় হয়, কখন না জানি মা গঙ্গা টেনে নেন।’’ কথা বলতে বলতে মাথা নড়ে সরস্বতীদেবীর, হাত কাঁপে। তবু বলে চলেন, ‘‘নাতি-পুতি, অন্য সবাই পালাতে পারবে। আমি তো আর পারব না। কত লোকের ঘর ভাঙল। অনেকে ভয়ে চলে গেল। আমিই শুধু অপেক্ষায় বসে আছি।” |
কীসের অপেক্ষা, বলতে পারেন না সরস্বতীদেবী।
গত কয়েক বছরে ইতিহাস প্রসিদ্ধ গারুলিয়ার কাঙালিঘাটের বাসিন্দাদের অনেকেই ঘর ছেড়েছেন ঘর ভাঙার ভয়ে। যাঁরা রয়ে গিয়েছেন তাঁদের আশা, ভাঙন রুখতে সরকার নিশ্চয়ই শিগগিরই কোনও ব্যবস্থা নেবে। উত্তর ২৪ পরগনরা এই পুর এলাকার বাসিন্দারা জানান, কয়েক বছর আগে একবার শাল খুঁটি দিয়ে ভাঙন আটকানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রবল জলের তোড়ে সেই খুঁটি উপড়ে গিয়েছে কিছুদিনের মধ্যেই। সরকারি ব্যবস্থা বলতে ভাঙনের মূল অংশে বালির বস্তা ও কিছু কংক্রিটের চাঙড় ফেলা হয়েছে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলিও যে খড়কুটোর মতো তলিয়ে যাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই বাসিন্দাদের।
গঙ্গার ধার বরাবর কাঙালিঘাট ঠাকুরবাড়ি রোড এলাকার বাসিন্দারা প্রায় সকলেই নিম্নবিত্ত। অধিকাংশেরই জীবিকা কল-কারখানায় কাজ করা নয় তো মাছ ধরা। ওপারে চন্দননগরের তেলেনিপাড়া ঘাট। কথিত আছে, কাঙালিঘাটের মাঝিকে ঘাটের স্বত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লা। সেই থেকে এই ঘাটে ফেরি চলাচলের জন্য কখনও অন্য ফেরি ঘাটগুলোর মতো ইজারা হয় না। ঘাটেরও দৈন্য দশা। শেষ কবে সংস্কার হয়েছে তাও মনে করতে পারেন না বাসিন্দারা। পাড় ভাঙার দৃশ্য দেখাতে নিজের ছিপ নৌকায় চড়িয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সনু চৌধুরী। মাঝগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরে কত বাড়ি আচমকা ভাঙল। রামনারায়ণ, জগন্নাথ চৌধুরীরা তো বুঝতেও পারেনি রাতের অন্ধকারে কখন ঘরের অংশ ধ্বসে গিয়েছিল। ওরা বাড়ি ছেড়ে চলেই গেল।’’ গঙ্গা থেকে পাড় বরাবর তাকালে বোঝা যায়, কাঙালিঘাটের কাছে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর বেশ কয়েকটা ঝুঁকে আছে গঙ্গার দিকে। কয়েকটা বাড়ির তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ায় সেগুলি গঙ্গার উপর কার্যত ঝুলছে। এলাকার নিকাশি ব্যবস্থাও অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। বাড়ির শৌচাগারের বর্জ্য, নিকাশির জল সবই পড়ছে গঙ্গায়। স্থানীয় বাসিন্দা জ্যোতি চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের অনেক সমস্যা। পুরসভা সবই জানে। কিন্তু যে ভাবেই থাকি, কোনও রকমে বাঁচছিলাম। এখন প্রতিদিন আতঙ্ক তাড়া করে এই বুঝি বাড়িটা জলে চলে গেল আর সবকিছু নিয়ে আমরাও তলিয়ে গেলাম। পুরসভায় থেকে লোক দেখানো কিছু বস্তা জলের মধ্যে ফেলেছিল। ফের যে কে সেই। বৃষ্টি বাড়লে খুব ভয় করে।’’
গারুলিয়ার পুরপ্রধান তৃণমূলের সুনীল সিংহের নিজের ওয়ার্ড কাঙালিঘাট এলাকা। তাঁর কথায়, ‘‘২০০৮ সাল থেকে এখানে ভাঙন শুরু হয়েছে। তখন সেচ দফতরে ছোটাছুটি করে কিছু করতে পারিনি। মাঝে একটু থমকালেও ফের পাড় ভাঙতে শুরু করছে গঙ্গা। সেচ দফতরে জানিয়েছি। বৃষ্টির জন্য কাজ থমকে আছে। খুব শিগগিরই বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু হবে।’’
পুরপ্রধানের এই আশ্বাস সম্বল করেই এখনও ঘর বাঁচানোর স্বপ্ন দেখছেন গঙ্গাপাড়ের মানুষ। |