কোথাও গোবর গ্যাস প্রকল্পে চৌবাচ্চা চুঁইয়ে নামছে পচাগলা দুর্গন্ধময় গোবর। কোথাও বাড়ির শৌচাগার থেকে মিশছে দূষিত জল। কোথাও আবার গোটা গ্রামের নালা-নর্দমা প্লাবিত হয়ে বদলে দিয়েছে পুকুরের জলের স্বাভাবিক রংটাই। অথচ প্রশাসন থেকে স্থানীয় বাসিন্দা কারও কোনও হেলদোল নেই!
সোমবার দুপুরে নানুর থানার কীর্ণাহারের আন্ত্রিক কবলিত এলাকায় গিয়ে অন্তত সেই দৃশ্যই ধরা পড়ল। দেখা গেল গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের লোকজন ওই সব নোংরা পুকুরেই দিব্যি যাবতীয় কাজ সারছেন। প্রশন তুলতেই সবার মুখেই প্রায় এক যুক্তি, “আগেও আমরা এ ভাবেই কাজকর্ম করে আসছি। কই এতদিন তো কিছু হয়নি!” কার্যত রাজ্যের অনেক গ্রামের মতোই কীর্ণাহার দক্ষিণ পাড়া কিংবা মেলে পাড়ার চিত্রটাও আলাদা কিছু নয়। প্রয়োজনীয় সচেতনা গড়ে তুলে বিপিএল তালিকাভুক্ত পুতুল মেটে, রাধারানি মেটে, কৃষ্ণা মেটেদের বিজ্ঞানসম্মত শৌচগার-ব্যবস্থা ব্যবহার করার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়নি। |
যার জেরে বছরের পর মাঠেঘাটে প্রাতঃকৃত্য করা কিংবা নোংরা পুকুরের জলেই প্রয়োজনীয় কাজ সারা রোখা যায়নি। ফলে নানা সময়ে ওই সব এলাকায় আন্ত্রিকের মতো রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। অন্য দিকে, নানুরের ভারপ্রাপ্ত বিএমএইচ সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় বলছেন, “জল দূষণের কারণেই ওই এলাকায় ডায়েরিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। দূষণরোধে স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭০-৭৫ জন পেটের রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।”
স্বাস্থ্য দফতর ও স্থানীয় সূত্রের খবর, দুর্গাপুজোর দু’ দিন আগে থেকেই প্রথম পেটের রোগ দেখা দেয় দক্ষিণ পাড়ায়। পাড়ায় মোট ৭২টি পরিবারে ৬২টিই বিপিএল তালিকাভুক্ত। কিন্তু শৌচাগার রয়েছে সাকুল্যে দশটি পরিবারের। তা-ও ব্যবহার করেন মাত্র ছ’টি পরিবার। সরকারি পানীয় জলের নলকূপ রয়েছে মাত্র ৪টি। যার মধ্যে কোনও একটি বছরভরই খারাপ হয়ে পড়ে থাকে। ওই পাড়াতেই বাড়ি সংশ্লিষ্ট কীর্ণাহার ১ পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান মানসী মেটের। এ দিন সেখানে গিয়ে দেখা গেল, তাঁর বাড়ির সামনে ডাঁই করা রয়েছে গোবর সার। গরুর প্রস্রাবের সঙ্গে মিশে সেই সার গলে গলে পড়ছে সামনের তাঁতি পুকুরে। শুধু ওই সারই নয়, কার্যত গোটা গ্রামের নালা-নর্দমার জলই অন্য একটি পুকুর (বেলে পুকুর) হয়ে তাঁতি পুকুরে মিশে জল দূষিত করে চলেছে। অথচ দেখা গেল সেই পুকুরেই নির্বিকার চিত্তে মঙ্গুলি মেটে, অনীতা মেটেরা বাসন ধোয়া ও হাতমুখ ধোয়ার কাজ করছেন। তাঁরা অবশ্য জানালেন, পুকুরে ধোয়ার পরে নলকূপের জল দিয়ে তাঁরা বাসনগুলি পরিষ্কার করে নেন। কিন্তু মুখ হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে? সেখানকার বাসিন্দা অভিরাম মেটে, ধীরাজ মেটেরা বলছেন, “এ ভাবেই হাত-মুখ ধুয়ে থাকি। কোনও দিন কোনও রোগ হয়নি।” এই প্রাচীন যুক্তিতে বছরভর তাঁরা বাধাহীন ভাবে নোংরা পুকুরের জলেই স্নান করা, বাসন মাজা, শিশুদের মলমূত্র পরিষ্কার করা সবই করেন। উপপ্রধানের বাড়িতেই দেখা মিলল বাড়ির একপাশে দাঁড় করানো রয়েছে সরকারি ভর্তুকিপ্রাপ্ত শৌচাগারের পুরনো প্যান-সহ চাতাল। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই অব্যবহৃত অবস্থায় ওই রকম প্যান পড়েই রয়েছে। কেই-ই তা ব্যবহার করেননি। মানসীদেবীর অভিযোগ, “ওই শৌচাগার ব্যবহারের উপযুক্ত ছিল না। তাই শৌচাগারের পরিবর্তে এলাকার মানুষ প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে মাঠেই যান।” তাঁরা ক্ষমতায় আসার পর উন্নতমানের শৌচাগার নির্মাণের প্রস্তাব নিয়েছেন বলে জানালেন।
এ দিন গ্রামে ব্লিচিং পাউডার, ক্লোরিনের গন্ধ পাওয়া গেল। এলাকার বহু মানুষ আন্ত্রিকে আক্রান্ত হওয়ার পরেই প্রশাসন খানিকটা নড়েছে। অস্থায়ী পানীয় জলের ট্যাঙ্কারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাময়িক ভাবে সিল করে দেওয়া হয়েছে গ্রামের নলকূপগুলিকে। একই চিত্র দেখা গেল লাগোয়া মেলে পাড়াতেও। ওই পাড়ায় প্রায় ১৫০টি পরিবারের বাস। বাসিন্দাদের অভিযোগ, সরকারি হিসেবে পাড়ায় প্রতিটি পরিবারেই শৌচাগার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ পরিবারই প্রাতঃকৃত্যের কাজ করেন মাঠেঘাটে। ইতিমধ্যেই ৫০টি পরিবারের প্রায় ১০০ জন পেটের রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে তাঁরা জানিয়েছেন। এ দিনই বাড়ির নালার সামনে অপর্ণা মেটে নামে এক কিশোরীকে বমি করতে দেখা গেল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এ দিন দক্ষিণ পাড়ায় নতুন করে কেউ আক্রান্ত না হলেও সকাল থেকে মেলে পাড়ার পাঁচ বাসিন্দাকে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। গ্রামের একাংশে দেখা গেল, কাঁচা নালা পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। স্থানীয় মঠপুকুরের পাড়েই রয়েছে একটি গোবর গ্যাসের প্রকল্প। সেখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে পচাগলা গোবর। কিছুটা দূরেই গ্রামের বাঁধা পুকুর। এই পুকুরের চারিদিকেই ৮-১০টি পরিবারের শৌচাগার থেকে দূষিত জল এসে মিশছে। আর সেখানেই দক্ষিণ পাড়ার মতো সুনীতা মেটে, মিঠু মেটেরাও হাত-মুখ ধোয়া, বাসন মাজার কাজ করছেন। নিজেদের পাশাপাশি গবাদি পশুদেরও তাঁরা ওই পুকুরেই স্নান করান। তাঁরাও জানান, গ্রামাঞ্চলে এ ভাবেই পুকুর ঘাটে এই সব কাজ করা হয়। এখানেও নলকূপগুলিকে বন্ধ করে দিয়ে অস্থায়ী ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে পানীয় জল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে প্রতিটি পরিবারেই। অজিত মেটে, হরি মেটেরা বলেন, “আমাদের পরিবারের অনেকেরই ডায়েরিয়া হয়েছে। এখন বাকিরাও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন।” এ দিকে কীর্ণাহার ১ পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সিপিএম প্রধান কৃপাশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় জানান, বছর পাঁচ ছ’য়েক আগে ওই সব পরিবারের সরকারি ভর্তুকিযুক্ত শৌচাগার অনুমোদন হয়েছিল। তাঁরা দাবি, “কেউ কেউ শৌচাগার নির্মাণও করেছিলেন। আবার প্রয়োজনীয় জায়গার অভাবে কিছু পরিবার শৌচাগার নির্মাণই করেননি। তবে আমাদের তরফ থেকে উদ্যোগের কোনও ঘাটতি ছিল না।” এই পরিস্থিতিতে ওই গ্রামে উন্নতমানের শৌচাগার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান ব্লক প্রশাসনও। নানুরের বিডিও মৃণালকান্তি বিশ্বাস বলেন, “এলাকার বাসিন্দাদের বিজ্ঞানসম্মত শৌচাগার ব্যবহারের ব্যাপারে উৎসাহের ঘাটতি রয়েছে। তবু আমরা প্রশাসনের তরফে এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যপারে উদ্যোগ নিয়েছি।” |