মানসিক রোগগ্রস্ত অবস্থায় শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন মা। পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যান। স্বামী ওই শিশুটির দায়িত্ব নিতে রাজি ছিলেন না তখন। কিন্তু মায়ের মন পরে তাঁকে বুঝিয়েসুঝিয়ে অনেকটা নরম করে এনেছিল। আর তখনই খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, সরকারি হেফাজত থেকেই বেমালুম বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে পাঁচ মাসের বাচ্চাটি।
মা মিনতি বর্মন সুস্থ হয়ে মাটিগাড়ায় নিজের শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর পাভলভ মানসিক হাসপাতালে জন্মানো ওই শিশুটিকে ভর্তি করা হয়েছিল কলকাতার একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে। সেখান থেকে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (সিডব্লুসি) মারফত একটি হোমে তাকে স্থানান্তরিত করা হয়। শিশুটি সম্পর্কে শেষ এই তথ্যটুকুই পাওয়া গিয়েছে। তার পরে সে কোথায় রয়েছে তা কেউ জানাতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে স্বাস্থ্য দফতর, শিশু কল্যাণ দফতর এবং কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অন্দরে। ইতিমধ্যেই সিডব্লুসি এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। অভিযোগের চিঠি পৌঁছেছে শিশুকল্যাণ দফতর এবং স্বাস্থ্যভবনেও। শিশুটির হদিস পেতে স্বাস্থ্যসচিবকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনও।
পাভলভ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন গত ৫ মে পুত্রসন্তানের জন্ম দেন মিনতিদেবী। সুস্থ হওয়ার পরে তাঁর স্বামী দয়াল বর্মন তাঁকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হলেও সন্তানের দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। দয়ালবাবুর বক্তব্য ছিল, বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার পরে গর্ভবতী হয়েছেন তাঁর স্ত্রী। তাই ওই সন্তান কোনও ভাবেই তাঁর নয়। মিনতিদেবীর চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, সন্তান ধারণের সময়ে মানসিকভাবে এতটাই অসুস্থ ছিলেন মিনতি যে, শিশুটির পিতৃপরিচয় জানাতে পারেননি তিনি। শিশুটিকে সরকারি হেফাজতে রেখে শেষ পর্যন্ত স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যান দয়ালবাবু।
মায়ের মন অবশ্য পড়েছিল শিশুটির কাছেই। স্বামীকে অনেক বুঝিয়ে আগামী সপ্তাহে কলকাতায় শিশুটিকে দেখতে আসার ব্যাপারে রাজি করিয়েছেন মিনতি। এখন মিনতিদেবী এলে তাঁকে কী উত্তর দেওয়া হবে, ভেবে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির কর্তারা। পৌঁছেছে মাটিগাড়ায় মিনতির কাছেও। সোমবার মিনতি বললেন, “বহু কষ্টে আমার স্বামীকে রাজি করাচ্ছিলাম যাতে উনি আমার সন্তানকে ফিরিয়ে নেন। আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। যে ভাবেই হোক, আমার সন্তানকে ফেরত চাই।”
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ৫ মে পাভলভে জন্মের পরে মিনতি ও তাঁর সন্তানকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখান থেকে মিনতি পাভলভে ফিরে এলেও শিশুটিকে রেখে দেওয়া হয় ন্যাশনালেই। পরে ন্যাশনাল থেকে তাকে বারাসতে সিডব্লুসি-র হেফাজতে দেওয়া হয়। সিডব্লুসির দাবি, তারা শিশুটিকে পাঠিয়েছিল বাগুইআটির একটি দত্তক এজেন্সিতে। কিন্তু তার পরে শিশুটি কোথায় গেল, সেই তথ্য কারও কাছেই নেই।
কিন্তু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের অনুমতি ছাড়া কোনও শিশুকে দত্তক এজেন্সিতে দেওয়া যায় না। মিনতিদেবীকে না জানিয়ে তবে শিশুটিকে বাগুইআটিতে পাঠানো হল কেন? মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, “কোনও সভ্য দেশে এমন ঘটে না। মায়ের অনুমতি ছাড়া কী ভাবে শিশুকে দত্তক এজেন্সিতে পাঠানো হল, স্বাস্থ্য-কর্তাদের তার জবাব দিতে হবে।” বারাসত সিডব্লুসি-র চেয়ারপার্সন অলোক মুখোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “হাসপাতাল থেকে আমাদের জানানো হয়েছিল যে, শিশুটি পরিত্যক্ত। তাই কারও অনুমতি নেওয়ার প্রশ্ন ছিল না।” পাভলভ কর্তৃপক্ষের কাছে সমস্ত তথ্য থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে শিশুটির গায়ে পরিত্যক্ত তকমা লাগানো হল? পাভলভ কর্তৃপক্ষ নীরব।
সিডব্লুসি কলকাতার চেয়ারপার্সন মিনতি অধিকারী আবার অন্য অভিযোগ করছেন। তাঁর বক্তব্য, “নিয়ম অনুযায়ী কোনও শিশুকে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে না পারলে তাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার সিডব্লুসি-র হেফাজতে দেওয়া হয়। পাভলভ এবং ন্যাশনাল দুটি হাসপাতালই কলকাতায়। শিশুটিকে কলকাতা শাখার হাতে তুলে দেওয়া হয়নি কেন?” মিনতির দাবি, এর দায় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ এবং পাভলভ কর্তৃপক্ষের।
কেন শিশুটিকে বারাসতে পাঠানো হয়েছিল, তার একটা ব্যাখ্যা অবশ্য দিয়েছেন অলোকবাবু। তাঁর বক্তব্য, ন্যাশনাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানিয়েছিলেন, সিডব্লুসি কলকাতা-র সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করতে পারছেন না। অথচ শিশুটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য রোজই অনেকে ভিড় করছেন। এতে তাঁদের কাজের সমস্যা হচ্ছে। তাই তাঁরা শিশুটিকে নিরাপদ হেফাজতে পাঠাতে চান। অলোকবাবুর দাবি, এর পরে তাঁরা বাগুইআটির একটি দত্তক এজেন্সির হাতে শিশুটিকে তুলে দেওয়ার জন্য ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন। অলোকবাবু বলেন, “ওই দত্তক এজেন্সিতে এর আগেও বাচ্চাদের পাঠানো হয়েছে। কখনও সমস্যা হয়নি। এখন শিশুটির ওই এজেন্সির হেফাজতেই থাকার কথা।”
কী বলছে ওই দত্তক এজেন্সি? এজেন্সির অধিকর্তা পার্থ মুখোপাধ্যায় সোমবার জানান, ৫ মে জন্মানো কোনও শিশু তাঁদের হেফাজতে নেই। তিনি বলেন, “৪ মে জন্মেছে, এমন একটি রুগ্ন শিশু আমাদের হেফাজতে রয়েছে। ৫ মে জন্মানো যে শিশুটি সম্পর্কে এত জিজ্ঞাসা, তার বিষয়ে আমাদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ কোন বাচ্চাটি কার, সে তথ্য আমাদের কাছে থাকে না। এর উত্তর সিডব্লুসি-র জানার কথা।”
তা হলে কোথায় গেল মিনতি বর্মনের শিশুপুত্র?
স্বাস্থ্য ও শিশু কল্যাণ দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কোনও কথা বলবেন না। মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইতিমধ্যেই এই অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি পাঠিয়েছে। সংগঠনের তরফে অদিতি বসু বলেন, “সরকারি হেফাজতে কোনও শিশু যদি নিরাপদ না থাকে, তা হলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে? আমরা শিশুটির সন্ধান চাই। কী ভাবে তা সম্ভব, সেটা সরকারকে ভাবতে হবে।” |