বিবাদেই বর। বিভিন্ন বাঁধ থেকে জল ছাড়া নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দিন পনেরো ধরে চলা বিতণ্ডার ঘটনাকে এখন এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছে ডিভিসি। কারণ, এই সমস্যা মেটাতে এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন বিবাদ না হয়, সে জন্য পথ খুঁজতে গিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বৈঠকে নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরতে পেরেছেন ডিভিসি কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রকে বোঝাতে পেরেছেন, বাঁধে পলি জমে জলধারণের ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে দ্রুত টইটম্বুর হচ্ছে সব জলাধার। ভবিষ্যতে যাতে আর পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বিবাদ না হয়, সে জন্য দরকার এই পলি সরানো এবং অবিলম্বে নতুন বাঁধ বা জলাধার গড়া। বলপাহাড়িতে নতুন বাঁধ তৈরির জন্য ইতিমধ্যেই সমীক্ষা চালিয়েছে সংস্থা। সব মিলিয়ে তাদের এখন বিপুল অর্থের প্রয়োজন। কেন্দ্র সেই টাকার ব্যবস্থা করুক।
দিনের শেষে তাই দেখা যাচ্ছে, মমতার সুরেই কথা বলছে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন।
ডিভিসি-র তরফে একই সঙ্গে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেন্দ্রের সঙ্গে এই বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতেই এ দিন রাজ্যের সঙ্গে আলোচনায় যায়নি তারা। ওই বৈঠক না-হওয়ার ফলে তারা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ঠিকই, কিন্তু ডিভিসি চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ সেনের দফতর সূত্রের বক্তব্য, এ দিন বৈঠকে গেলেই মমতার সঙ্গে তাঁদের আবার কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে যেত। তখন ঝাঁপিয়ে পড়ত সংবাদমাধ্যম। ফলে সমস্যা সমাধানের বদলে তিক্ততা আরও বাড়ত। কিন্তু তিনি তা চান না। তাই তিনি এ দিন রাজ্যের সঙ্গে বৈঠক এড়িয়ে গেলেন। কলকাতায় সমস্ত অফিসারকে চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, রাজ্যের সঙ্গে ঝগড়া করা তো সংস্থার কাজ নয়।
একই ভাবে কেন্দ্রীয় শক্তি প্রতিমন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াও চান না, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে এ ভাবে বিবাদ চলুক এই কেন্দ্রীয় সংস্থার। সে জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, পারস্পরিক দোষারোপকে অগ্রাধিকার না দিয়ে সমস্যার সমাধান করাটা অনেক বেশি জরুরি। সেই সমাধান খোঁজার লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎসচিব প্রকাশকুমার সিংহ আজ ডিভিসি অফিসার্স ফোরামের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করেন। পরে আবার যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার
সঙ্গেও বৈঠক করেন অফিসার্স ফোরামের প্রতিনিধিরা।
শক্তিসচিবের সঙ্গে বৈঠকে ওঠে বলপাহাড়িতে নতুন বাঁধ তৈরির বিষয়টিও। শক্তি মন্ত্রক তখন বাঁধ তৈরি নিয়ে ডিভিসি-কে সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার পাশাপাশি জানিয়ে দেয়, ওই বাঁধ তৈরির জন্য বিশ্বব্যাঙ্কের সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। ডিভিসি চাইছে বলপাহাড়ি ছাড়াও পুরুলিয়ায় ছোট ছোট ২৫টি বাঁধ নির্মাণ করতে। এই জলাধারগুলি তৈরি হয়ে গেলে বাড়তি জল এখানে সঞ্চয় করা সম্ভব হবে। ছোট বাঁধগুলির এক একটি তৈরিতে খরচ হবে ৩ লক্ষ টাকা করে। তবে বলপাহাড়ি বড় প্রকল্প। এর জন্য প্রয়োজন আট হাজার কোটি টাকা।
এর পাশাপাশি বাঁধে পলি জমার প্রসঙ্গটিও ওঠে আলোচনায়। ডিভিসি সূত্র বলছে, বাঁধগুলি তৈরির সময় বৃষ্টির ফলে জল যাতে বিপদসীমা অতিক্রম করতে না পারে, সে জন্য একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবু বাঁধে পলি জমে তার জলধারণ ক্ষমতা কোনও কোনও ক্ষেত্রে ৬০% পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু পাঞ্চেত ও মাইথন জলাধার থেকে পলি তুলতে খরচ হবে যথাক্রমে ৮ ও ৫ হাজার কোটি টাকা। ডিভিসি-র যে অফিসার্স ফোরাম এ দিন শক্তিসচিবের সঙ্গে বৈঠক করে, তাদের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয়কুমার সিংহ বলেন, “পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে এই বাঁধের উপর জমা পলিমাটি সরাতে প্রয়োজন প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।”
এখন প্রশ্ন, এত টাকা আসবে কোথা থেকে?
অর্থ যে ডিভিসি-র কাছে বড় সমস্যা, এ দিন কেন্দ্রকে তা ভাল ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন সংস্থার আধিকারিকরা। সঞ্জয়কুমার সিংহরা শক্তিসচিবকে জানান, ১৯৪৮ সালে ডিভিসি তৈরির পর থেকে ২০ বছরে কেন্দ্র তাদের দিয়েছে ২১৫ কোটি টাকা। তার পর থেকে কানাকড়িও ছোঁয়ানো হয়নি আর। শুধু বছর তিনেক আগে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন প্রণব মুখোপাধ্যায় ডিভিসি-কে বাজারে বন্ড ছেড়ে সাত হাজার কোটি টাকা তোলার ব্যবস্থা করে দেন। এ ছাড়াও ঝাড়খণ্ডের কাছে ছ’হাজার কোটি, অনিল অম্বানীর বিদ্যুৎ সংস্থা বিএসইএসের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাবে সংস্থা।
কেন্দ্র কেন সেই টাকা উদ্ধার করে দিচ্ছে না, এ দিন সেই প্রশ্ন তুলেছেন ডিভিসি কর্তারা। ওই টাকা পেলে পলি সরানোর কাজ অনেকটাই করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে ডিভিসি। সঞ্জয়বাবুদের দাবি, “পলি তোলার জন্য যে ৩০ হাজার কোটি টাকা দরকার, তার মধ্যে অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকা অবিলম্বে দিতে হবে কেন্দ্রকে।” ডিভিসি কর্তারা শক্তিসচিবকে জানিয়েছেন, সংস্থার বাজেট থেকে তাঁরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য টাকা খরচ করবেন। পলি সরানোর জন্য সেই টাকা খরচ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ, পলি সরানো থেকে রোজগার হয় না (অর্থাৎ নন-প্রোডাকটিভ)। তা ছাড়া, এক বার তোলা হলেও পলি ভবিষ্যতে আবার জমবে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা না বাড়ালে এলাকার উন্নয়ন ব্যাহত হবে। সংস্থার আয়ও বাড়বে না। ডিভিসির দাবি, রঘুনাথপুর ফেজ-২ প্রকল্পের জন্য সাড়ে ন’হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। ওই
প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পুরুলিয়ার পশ্চিমাংশের অনুন্নত এলাকাগুলি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
এই সব কারণে ডিভিসি চাইছে, পলি সরানোর জন্য যে খরচ, সেই টাকা কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলি মিলিয়ে তাদের হাতে তুলে দিক। একই সঙ্গে বাজারে যে টাকা বকেয়া আছে, তা-ও তুলে দিক কেন্দ্র। এই সূত্রেই এ দিন সংস্থার অফিসাররা তুলেছেন সংস্থার প্রতি আর্থিক বঞ্চনার প্রসঙ্গ। কেন্দ্র ও যোজনা কমিশনের কাছে ডিভিসি
অফিসার্স ফোরাম দাবি জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্বাঞ্চলে ডিভিসি-র উপর আর্থিক বঞ্চনার যে ট্র্যাডিশন গড়ে উঠেছে, তার অবসান ঘটানো হোক। সংস্থার তরফে কেউ কেউ বলছেন, আসল সমস্যা টাকা। তা পেলে নতুন জলাধার নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে পলি সরানোর ব্যবস্থাও হবে। তাতে বন্যা আটকাবে। আর পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভবিষ্যতে বিবাদের সম্ভাবনাও কমে যাবে। এ বারে রাজ্যের সেচ দফতরের কাছ থেকে সদর্থক মনোভাব দেখানোর চেষ্টা হয়েছে বলেও ডিভিসি-র বক্তব্য। তাই কর্মীদের চাপে কাল সংস্থা আরও একটি বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা করবে ঠিকই, কিন্তু রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতের পথে হাঁটবে না। বরং সাম্প্রতিক ঝগড়া থেকে ফায়দা তুলে কেন্দ্রের কাছ থেকে টাকা ও বকেয়া আদায়ের চেষ্টা করে যাবে।
আর তাই ডিভিসি কর্তৃপক্ষ মনে করছেন, মমতার তোলা অভিযোগ ধরে যে বিবাদ শুরু হয়েছিল, তাতে আখেরে বরলাভই হয়েছে সংস্থার।
|