রাতের আকাশে তারার দেখা নেই। ফের বৃষ্টি নামতে পারে যে কোনও সময়। জমাট অন্ধকার ভেদ করে জীর্ণ বাঁধটার উপরে জ্বলে ওঠে একটা, দুটো করে লন্ঠনের আলো। টিমটিম করে জ্বলতে থাকা সেই আলোর সারি ঘুরে বেড়াতে থাকে বাঁধের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। বাড়িতে কোলের সন্তানকে ঘুম পাড়িয়েও দুশ্চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন না মা। ভাঙনের মতিগতি দেখে গ্রামকে সতর্ক করতে মাঝে মধ্যেই বেজে ওঠে থালা, বাঁশি কিংবা শঙ্খ। ভাগীরথীর ভাঙনে ভিটে হারানোর ভয়ে এ ভাবেই রাতভর জেগে থাকে রাজাপুর।
বেলডাঙার মহুলা মোড় থেকে চার কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে ভাগীরথীর গা ঘেঁষা নদীবাঁধ। পাশেই রাজাপুর হাজরাপাড়া। ক্যালেন্ডারের হিসাবে বর্ষা শেষ হয়ে গেলেও আকাশের ভাবগতিক দেখে ভরসা পাচ্ছেন না নদী পাড়ের বাসিন্দারা। উত্সবের আনন্দ থেকে শত যোজন দূরে থাকল রাতজাগা ওই গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, “ভাতা, বিপিএলের চাল এসব আমরা চাই না। বাঁধটাকে পোক্ত করুক প্রশাসন।” |
ভাঙছে নদীবাঁধ। আতঙ্কিত এলাকার বাসিন্দারা।—নিজস্ব চিত্র। |
রাজাপুরের এমন ভোগান্তি এবারই প্রথম নয়। আকাশে মেঘ জমলেই দুশ্চিন্তা বাড়ে গ্রামের। বহু পুরনো এই নদীবাঁধ সংস্কার হয়নি বহু দিন। বেশ কিছু জায়গা ভেঙেও গিয়েছে। মহুলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক বলছিলেন, “গ্রামে নেতা, মন্ত্রী যাঁরাই এসেছেন তাঁদের সবাইকেই বাঁধটা সংস্কারের কথা বলেছি। কিন্তু কোথায় কী! আমাদের কথা কেউ কানেই তুলছেন না।” গ্রামের টুটু হাজরা বলেন, “আমাদের আবার পুজো! দিনমজুরি করে স্বামী যতক্ষণে চাল কিনে বাড়ি ফেরে তখনই উনানে হাঁড়ি চড়ে। তার উপর শেষ সম্বল, ভিটেটুকুও যদি নদী গিলে খায় তাহলে সবাইকে ভেসে যেতে হবে। দিনটা কোনওরকমে কেটে যায়। কিন্তু রাত মানেই আমাদের কাছে অনিদ্রা আর আতঙ্ক।”
রাজনীতির কারবারিরা ব্যস্ত। প্রশাসন এখনও পর্যন্ত কিছুই করে উঠতে পারেনি। তাই গ্রামকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়েছেন গ্রামবাসীরাই। নদী পাড়ের বেশ কিছু বাড়িতে মজুত রাখা হয়েছে বালির বস্তা। বাঁধে ফাটল দেখা দিলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন গ্রামের মানুষ। বালির বস্তা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করা হয় ফাটল।
গ্রামের সুফল হাজরা, কৃষ্ণ হাজরা, বসন্ত হাজরাদের কথায়, “জানি এভাবে ভাঙন ঠেকানো যাবে না। তবুও কেউ যখন আমাদের কথা ভাবছেই না তখন সব হারানোর আগে একটা শেষ চেষ্টা করছি।” গ্রামের মহিলারা বলছেন, “বৃষ্টি না হলে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকি। কিন্তু বৃষ্টি হলেই খুব ভয় লাগে। মনে হয় এই বুঝি বাঁধ ভেঙে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। রাতে বাড়ির পুরুষরা লন্ঠন হাতে পালা করে বাঁধ পাহারা দেন। জল কত উপরে উঠল তা খেয়াল রাখেন। আমরাও ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে জেগে বসে থাকি। বাঁধের উপর থেকে বাঁশি বাজিয়ে বিপদের সঙ্কেত এলেই আমরাও থালা বাজিয়ে গোটা গ্রামকে সতর্ক করি। এভাবে যে কতদিন চলবে বুঝতে পারছি না।”
জেলাপরিষদের সদস্য কংগ্রেসের নজরুল ইসলাম বলেন, “গ্রামের এমন অবস্থার কথা জেনে আমরাও কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই। পুজোর মধ্যে সরকারি দফতর সব বন্ধ ছিল। এখন গ্রামের মানুষের গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে জানাব।” বহরমপুরের সেচ দফতরের বাস্তুকার সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ের ওই এলাকায় বাঁধ নিয়ে সমস্যার কথা উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকেও জানিয়েছি। খুব শীঘ্রই ওই নদী বাঁধের কাজ শুরু হবে।” বহরমপুরের মহকুমাশাসক অধীর বিশ্বাস বলেন, “এই সমস্যাটা বেশ পুরনো। ওই নদী বাঁধ মেরামত করার জন্য খুব দ্রুত পদক্ষেপ করা হবে।” প্রশাসনের কত মাসে বছর হয় সেটাই এখন দেখার। |