অন্ধকারের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আকাশচুম্বী বহুতল। আচমকাই একটি বিকট শব্দ। তার পরেই ওই বহুতলের ছাদ ছাপিয়ে একটি আলোর গোলা সোজা উঠে গেল আকাশে। আবার একটা বিকট শব্দ। তার পরেই অন্ধকারের বুক চিরে রং-বেরংয়ের আলোর মালা ভাসতে শুরু করল আকাশে।
রঙিন আতসবাজি শেল-এর সৌজন্যে কালীপুজোর রাতের এই ছবিটা আজ আর অচেনা নয়। কিন্তু শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণে নেমে চকলেট বোমের পাশাপাশি এই শেল-ও এ বার পুলিশের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। এর দৌরাত্ম্য রুখতে এ বার তাই নাইট ভিশন বাইনোকুলারের সাহায্য নিতে চলেছে কলকাতা পুলিশ। এই শব্দাসুরটিকে শাসনের জন্য বেশ কিছু বহুতলকে চিহ্নিত করে এ বছর আগাম কিছু প্রস্তুতিও নিয়েছে কলকাতা পুলিশ।
লালবাজারের কর্তাদের কথায়, শেল আকাশে ওঠার সময় পিছনে একটা সাদা ধোঁয়ার রেখা দেখা যায়। নাইট ভিশন বাইনোকুলারের মাধ্যমে ওই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর উপরে নজর চালালেই বোঝা যাবে কোন আবাসন থেকে তা ছাড়া হয়েছে। তাতে অভিযান চালানো সহজ হবে।
পুলিশ ও পরিবেশ দফতর অবশ্য প্রতি বছরই শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণে যৌথ ভাবে শহরের অলিগলিতে হানা দেয়। তাতে প্রচুর চকলেট বোমা বাজেয়াপ্ত হয়, লোকজনও গ্রেফতার হন। কিন্তু পুলিশ ও পরিবেশ কর্মীদের নাকের ডগাতেই প্রতি বছর একের পর এক এই শেল ফাটতে থাকে। বহুতল আবাসনগুলির দরজা বন্ধ থাকায় কিছুই করা যায় না। এক পুলিশ কর্তার কথায়, “অনুমান করে কোনও আবাসনের সামনে পৌঁছনোর পরে বহু ডাকাডাকি করে দরজা খোলাতে হয়। তত ক্ষণে অবশ্য সমস্ত শব্দবাজিই লোপাট হয়ে যায়। হাতেনাতে প্রমাণ না-পাওয়ায় কিছুই করার থাকে না।”
লালবাজার সূত্রের খবর, এ বার তাই রণকৌশল বদলেছেন পুলিশকর্তারা। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আকাশচুম্বী বহুতল ও সাধারণ বহুতলগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে দেদার শেল ফাটে। যাদবপুর, ই এম বাইপাসের লাগোয়া এলাকা-সহ কলকাতা পুলিশের বিভিন্ন এলাকায় যে সমস্ত বহুতল রয়েছে, সেগুলির নিরাপত্তারক্ষী ও পরিচালন কমিটির সঙ্গে স্থানীয় থানার অফিসারদের প্রাথমিক বৈঠকও হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, এ বার কালীপুজোর দিন আবাসনের মূল দরজা খোলা রাখতে বলা হয়েছে। নিরাপত্তারক্ষীদের ফোন নম্বর থানায় জমা দিতে বলা হয়েছে এবং আবাসনের ভিতরে সব সিসি টিভি সচল রাখার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। শহর ও শহরতলির কয়েকটি আকাশচুম্বী বহুতলের ছাদে পুলিশ মোতায়েন করার কথাও ভাবা হচ্ছে বলে জানান এক কর্তা।
শব্দবাজি শেল ফাটানোয় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে? এক পুলিশ কর্তা জানালেন, ৯-বি বিস্ফোরক আইন অনুযায়ী ধৃতের তিন মাস পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা হতে পারে। আবার কলকাতা পুলিশের শহরতলি আইনের ৪০ নম্বর ধারা অনুযায়ীও ধৃতের জেল ও জরিমানা হবে। যদিও বাজি ব্যবসায়ীদের একাংশ এখনও যুক্তি দেখাচ্ছেন, শেল আদতে আলোর বাজি। শব্দবাজি নয়। কিন্তু এ যুক্তি মানতে রাজি নয় পুলিশ। কারণ, শিবকাশীর তৈরি এই বাজির চরিত্র কিছুটা দোদমার মতো। পুলিশের কথায়, সলতেয় আগুন লাগার পরে প্রথমে মাটিতে এক বার বিকট শব্দ করে ফেটে শেল সোজা উঠে যায় অনেকটা উঁচুতে। সেখানে বাতাসের সংস্পর্শে এসে আর এক বার বিকট শব্দ করে ফাটে। তার পরেই আলোর মালায় চার দিক আলোকিত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ পরে আলো ছড়ালেও দু’বার বিকট শব্দে ফাটে এই শেল। তাই এটা শব্দবাজিই। শিবকাশীর ব্যবসায়ীরাও বলছেন, “যত জোরে শব্দ হবে, ততই উপরে উঠবে শেল। আর যত উপরে উঠবে, ততই ছড়াবে রোশনাই। তাই জোরে বিস্ফোরণটা অত্যন্ত জরুরি। শেলের বিকট আওয়াজ ১২৫ ডেসিবেলের চকলেট বোমাকেও ছাড়িয়ে যায়।”
ইএনটি চিকিৎসকদের মতে, অন্য বাজির থেকে শেলের ক্ষতিকর দিক অনেক বেশি। যেমন, চিকিৎসক দীপঙ্কর দত্ত বলেন, “এখানে ক্ষতি হয় দু’বার। কারণ এই ধরনের বাজিগুলিতে দুটি স্তরে আওয়াজ হয়। প্রথমটি মোটা, দ্বিতীয়টি তীক্ষ্ন। ফলে আমাদের কানের ভিতরের মোটা কম্পাঙ্কের প্রতি সংবেদনশীল স্নায়ু এবং কিছু পরেই তীক্ষ্ন কম্পাঙ্কের প্রতি সংবেদনশীল স্নায়ু উভয়ই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।” এই ধরনের বিকট শব্দ পর-পর দু’বার শোনার ফলে আচমকাই কান স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন ইএনটি চিকিৎসক তুষারকান্তি ঘোষ। তিনি বলেন, “আচমকা কান বন্ধ হয়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার চিকিৎসা করা প্রয়োজন। না হলে পরে রোগী পুরোপুরি বধির হয়ে যেতে পারেন। এই ধরনের বিকট আওয়াজ ক্রমাগত শুনলে মনসংযোগ নষ্ট, মাথা ধরার মতো সমস্যাও হতে পারে।”
চিি কৎসক ও বিজ্ঞানীরা এ-ও জানাচ্ছেন, শব্দ বাজি ফাটার সময় মুখ সামান্য হাঁ করা থাকলে, কানের পর্দার ক্ষতি কিছুটা কমানো বা এড়ানো যায়, কিন্তু শেল-এর ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা বেশি বিপজ্জনক। কারণ প্রথম বার মাটির কাছে ফাটার সময় এগুলি যে ধরনের বিষ-গ্যাস ছড়ায়, তা অন্যান্য বাজির দূষণের চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতিকর। মুখ হাঁ করা থাকলে, সেই ধোঁয়া এক ধাক্কায় অনেক বেশি পরিমাণে ফুসফুসে ঢুকে পড়ে।
কালীপুজোয় এ বার তাই শেল-এর মুখ বন্ধ রাখাই অন্যতম লক্ষ্য কলকাতা পুলিশের।
|