সর্বশিক্ষার প্রকল্পে প্রতিবন্ধী শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ‘স্পেশাল এডুকেটর’দের।
অথচ শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি তাঁদের। প্রকল্প শেষ হলে এই শিশুদের শিক্ষার ভার কারা নেবেন?
ঝর্না পান্ডা |
গত এক বছরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ চোখে পড়ে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থাটি ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়িত করতে হলে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসা ত্রুটিগুলি বা সমস্যাগুলিকে সবার আগে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
যেমন, বর্তমানে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের প্রাক্-প্রাথমিক পড়ানোর উদ্যোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু প্রি-প্রাইমারি সেকশন চালু হলেও শিক্ষক নিয়োগের কী হবে? শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী চুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। শিক্ষক নিয়োগ প্রয়োজন অনুযায়ী না হলে স্কুল চত্বরে ছোট ছোট শিশুদের দায়িত্ব কে নেবেন? ভিন রাজ্যে গরম কড়াইয়ে শিশুমৃত্যুর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি নিশ্চয়ই আমরা চাইব না।
এই রকমই আরও একটি সমস্যা হল, বিশেষ চাহিদা-সম্পন্ন শিশুদের যথাযথ প্রশিক্ষণের বিষয়টি। ‘স্কুল চলো’ অভিযানের মতো প্রকল্পগুলি শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করে তুলতে পেরেছে। আর এই কারণেই বিদ্যালয়ে অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদা-সম্পন্ন শিশুদের নামও আমরা নথিভুক্ত করতে পেরেছি। বহু অভিভাবক, বিশেষত মায়েরা তাদের যাবতীয় কাজ ফেলে তার প্রতিবন্ধী শিশুটিকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসছেন। এটা একটা বড় সাফল্য। অভিভাবকদের এই আগ্রহ ও সচেতনতাকে কাজে লাগিয়ে এই শিশুদের প্রয়োজন-অনুযায়ী শিক্ষা দিতে পারতেন স্পেশাল এডুকেটর-রা, যাঁরা সর্বশিক্ষার চুক্তিভিত্তিক কর্মী। |
কিন্তু বাস্তব বলছে, রাজ্যের কোথাওই চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্পেশাল এডুকেটর নিয়োগ হয়নি। প্রতি চক্রে (সার্কেল অফিস) যেখানে মানসিক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য অন্তত তিন জন স্পেশাল এডুকেটর থাকা দরকার, সেখানে অনেক সময়ই দেখা যায় চার-পাঁচটা চক্র মিলিয়ে মাত্র এক জন রয়েছেন। শিশুদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগই এঁদের তেমন ভাবে নেই। থাকার মধ্যে রয়েছে ব্লক স্তরে সার্কেল লেবেল রিসোর্স সেন্টারে একটি রিসোর্স রুম, যেটি সপ্তাহে দু’দিন খোলা থাকে। কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েতে ছড়িয়ে থাকা প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে সপ্তাহে দু’দিন রিসোর্স সেন্টারে আসার সুযোগ অধিকাংশ অভিভাবকেরই থাকে না। একই ভাবে, স্পেশাল এডুকেটরদেরও সেন্টারে যাওয়ার সুযোগ প্রায় নেই। কারণ, সর্বশিক্ষার প্রচুর প্রোগ্রামের থোক টাকা বিলিব্যবস্থায় এঁদের দিন কাটে।
সঙ্গে রয়েছে কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ বা সর্বশিক্ষা মিশনের নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দ ছুটির কোনওটাই স্পেশাল এডুকেটরদের জন্য নির্দিষ্ট নয়। তার ওপর আবার মাঝে মাঝেই প্রাপ্য ছুটিগুলিও বাতিল হওয়ার নির্দেশ আসে। মাত্র আট হাজার টাকা বেতনে সংসার চালাতে হয় এঁদের। পরিবহণ খরচ বাড়লেও যাতায়াতের জন্য কোনও বাড়তি টাকা হাতে তুলে দেওয়া হয় না। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
রাজ্য জুড়ে ৭২৬টি সার্কেলের ১৩০০ জন স্পেশাল এডুকেটরদের নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দল বা সরকারের মাথাব্যথা নেই। পরিবহণ খরচ বাবদ দু’-পাঁচশো টাকার অনুমোদন না হলেও বছর তিনেক পর পাঁচ শতাংশ বেতনবৃদ্ধির ঘটনা অতি সাম্প্রতিক। তাও আবার ২০১০ সালে জুন মাসের পর যাদের নিয়োগ করা হয়েছিল, তাঁরা ৪০০ টাকা বেতনবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হলেন। তার ওপর আবার, অধিকাংশ জেলাতে স্পেশাল এডুকেটরদের জন্য নতুন সিলেবাস বা পেডাগজি ট্রেনিং-এর পরিকল্পনাটুকুও করা হল না।
তবে প্রধান সমস্যাটি হল, গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে শিক্ষক হিসেবে এঁদের কোনও স্বীকৃতি নেই। স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে ক্লাসে গিয়ে প্রতিবন্ধীদের সুবিধা-অসুবিধার দিকটা বুঝে পড়ানোর ধরন ঠিক করে দেওয়ার কথা এঁদের। কিন্তু এক জন স্পেশাল এডুকেটরের অধীনে রয়েছে ৮০-৮৫টা স্কুল। তাই তা সম্ভব হয় না। দিবস পালন অনুষ্ঠান, শিশু সহায়ক যন্ত্রপাতি ও টাকা বিলি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা এ সব সামলেও যাঁরা শিশুদের কাছে পৌঁছতে চান, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বাধাপ্রাপ্ত হন নানা ভাবে। ‘আবার এসেছেন?’ শিক্ষকরা বিরক্ত হন, নানা অজুহাতে শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগ করে দিতেও অস্বীকার করেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য অনেক সময়ই একটি ক্লাসও স্পেশাল এডুকেটরদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয় না।
প্রাথমিক স্কুলগুলিতে যদিও বা এঁদের সামান্য হলেও গ্রহণযোগ্যতা আছে, আপার প্রাইমারি বা উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতে তা না-থাকারই নামান্তর। ছাত্রছাত্রীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য কত বার যে স্পেশাল এডুকেটরদের স্কুলে যেতে হয়! আজ অমুক ছাত্র আসেনি, ছাত্রের বাড়িতে খবর পাঠানো যাবে না, কাল-পরশু নাগাদ আসুন এ ভাবেই চলতে থাকে এক দিকে শিক্ষকদের অসহযোগিতা, অন্য দিকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য জেলাশাসকের নির্দেশ। অসহায় বোধ করেন বিশেষ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত এই শিক্ষকরা। আমরা খোঁজও রাখি না যে, উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতে এঁদের গ্রহণযোগ্যতার অভাবের ফলেই আপার প্রাইমারিতে ভর্তি হয়েও রাজ্য জুড়ে বহু প্রতিবন্ধী শিশু ড্রপআউট হচ্ছে। অপ্রাপ্তি, অন্যায্য ভাবে কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা, এবং বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তা প্রয়োগের অভাব হতাশা গ্রাস করে রত্না, সুজিত, দুখিরামদের।
অন্য একটি আশঙ্কার কথাও মনে হয় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে স্পেশাল এডুকেটরদের নিয়োগ করার পরিকল্পনা না করলে, লক্ষাধিক প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না তো? সর্বশিক্ষার মিশন তার পূর্ব নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রম করার পর সর্বশিক্ষার এই প্রকল্প-ভিত্তিক শিক্ষকরাই বা কোথায় যাবেন? সর্বোপরি রাজ্যের ২,৭০,০৬০টি বিদ্যালয় জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আমাদের ১,৯৩,১৮০ জন প্রতিবন্ধী (পশ্চিমবঙ্গ সর্বশিক্ষার মিশন বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০১১-১২ তথ্য অনুযায়ী) শিশুর শিক্ষার অধিকার নিয়ে নীতি-নির্ধারকরাই বা কী ভাবছেন? প্রকল্প বন্ধ হলে, চুক্তি-ভিত্তিক এই শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে কারা নেবেন এদের শিক্ষার ভার?
কয়েক মাস আগে কলকাতা জেলার ১২৫ নম্বর ওয়ার্ডে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধী শিশুদের অভিনীত নাটক চলাকালীন মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়েদের (স্পেশাল এডুকেটর দিদিমণিদেরও) গর্বিত মুখ দেখলে মনে হয় সকল অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিশুর মায়েদের এই সচেতনতা ও আগ্রহকে ধারাবাহিক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে কিন্তু বিঘ্নিত হবে আমাদের শিক্ষার অধিকার আইনটি। |
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ গবেষক |