একের অধিকার অবশ্যম্ভাবী করে অন্যের অনধিকারকে। এক রাষ্ট্রের বাসিন্দার অধিকার
মানে অন্য রাষ্ট্রের মানুষের অনধিকার। মানুষের অধিকার মানে পশুর (এবং শিশুর)
অনধিকার। এক সময়ে নারীও এই সীমানার বাইরে থেকেছে।
অনির্বাণ দাশ |
একটি মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে প্রেমিককে। মেয়েটির পরিবার ঝাঁপিয়ে পড়ল তাকে ‘উদ্ধার’ করতে। তার পর কোর্টকাছারি। যদি নাবালিকা হয়, তাকে হয় ফেরত পাঠানো হবে নিজের বাড়িতে মানে যেখান থেকে সে পালিয়েছে, না হয় তার স্থান হবে সরকারি উদ্ধার-আশ্রমে। কখনও, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে কোর্ট সংবেদনশীল হয়েছে মেয়েটির ব্যাপারে। তাকে যেতে দিয়েছে বরের সঙ্গে। বাপের বাড়ি আর বরের বাড়ির মধ্যে বেছে নেওয়ার একটা স্বাধীনতার পরিসর সে পেয়েছে। খণ্ড স্বাধীনতা, তবু। সম্প্রতি দিল্লি হাইকোর্টের এক রায়ে এই রকম একটা ব্যাপার ঘটল। বছর ষোলোর একটি মেয়েকে তার ইচ্ছে অনুযায়ী বরের ঘরে যেতে দিয়েছে কোর্ট।
মেয়েটির নিজস্ব ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করার অধিকার কি এ ঘটনায় স্বীকৃত হল? না কি আঠেরোর আগে বিয়ের রাস্তা খুলে গেল পরিবারগুলোর কাছে? গত কয়েক মাস কিংবা বছর ধরে যে মেয়েগুলো বিয়ে না করে পড়তে যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত কার্যকর করছিল পরিবার-আত্মীয়-পাড়াপড়শীর প্রায় অনতিক্রম্য বাধা পেরিয়ে, তাদের কাজটা কি কঠিন হয়ে গেল আরও? (কতখানি মানসিক দৃঢ়তা থাকলে পরতের পর পরত বাধা পেরিয়ে বিয়ে বন্ধ করার এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? আর কবে আমরা লিখব দৈনন্দিনের ভিতরকার এই মহাকাব্যপ্রতিম কাহিনিগুলো?) |
আর যদি দুটোই সত্যি হয়? একেবারে সোজাসুজি না হলেও মেয়েটির মত জায়গা পেল আদালতের রায়ে, আবার এর ভিতরে অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দেবার প্রথাও বৈধতা পেল খানিকটা। জীবনের ঘটনাগুলো, ভাবনার বিমূর্ত ধরনের বাইরে এ রকম মিলেমিশেই তো থাকে। তা হলে, যখন ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবি, কোনটাকে গুরুত্ব দেব? কী ভাবে ভাবব? শুরুতে ঠিক করি, কোন বিষয়গুলো উঠে এল ঘটনার ভিতরে। কোন বিমূর্ত প্রশ্নগুলো? ওগুলো ছাড়া তো ভাবা যাবে না।
আমার শরীরের ওপর অধিকার কার?
আমার, না রাষ্ট্রের?
অধিকার কি সবার একই রকম থাকা উচিত? শিশুর? পাগলের? কোমায় থাকা মানুষের?
অধিকার মানেই কি অধিকারীভেদ? যেখানে সবার অধিকার সমান নয়। কে কোন কাজটা করতে পারে আর কোনটা পারে না, ঠিক করে দেওয়া আছে সামাজিক ভাবে। যেমনটা জাতভেদ প্রথায়। ব্রাহ্মণ আর শূদ্রের কাজের সীমানা ঠিক হয়ে আছে কঠোর ভাবে। অতটা অনমনীয় নয় অধিকারের ক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে, অথচ অধিকারীভেদ থেকেই যাচ্ছে, এটাই তো পরিচিত কাঠামো আমাদের।
অধিকারীভেদ-এর পথ দিয়েই কি অধিকার-হরণের রাস্তা খুলে যায় না? পুরুষের মনে হয় না, নারী এখনও নিজের ভাল বোঝার মতো পাকা মাথার মানুষ হয়ে ওঠেনি?
সাদা মানুষের মনে হয় না, কালো মানুষ কিংবা উপনিবেশের লোকেরা সার্বভৌম গণতন্ত্রের যোগ্য হয়ে ওঠেনি?
মনে হয় না, ওরা সব এখনও শিশু? অবোধ?
অথচ কোনও অধিকারের ধারণাই কি সর্বত্রগামী হতে পারে? না কি অধিকারের ধারণা ‘এক্সক্লুশন বা বহিষ্কার-এর উপর দাঁড়িয়ে থাকে। একের অধিকার অবশ্যম্ভাবী করে তোলে অন্যের অনধিকারকে। এক রাষ্ট্রের বাসিন্দার অধিকার মানে অন্য রাষ্ট্রের মানুষের অনধিকার। মানুষের অধিকার মানে পশুর (এবং শিশুর) অনধিকার। ইতিহাসের এক একটা সময়ে নারীও এই সীমানার বাইরে থেকেছে।
ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব অবিভাজ্য, এই কথা ভেবে নেওয়ার উপর অধিকারের ধারণা ভর করে আছে। অবিভাজ্য এবং পরিণত। এই ধারণা বলে কর্তব্যের ভার যে বহন করতে পারে, অধিকারও তারই পাওনা। অপরিণতমনস্ক যে শিশু, পাগল, অসুস্থ কিংবা অপরাধী পূর্ণ সামাজিক মানুষের কর্তব্য পালন করতে পারে না অথবা করে না, তার অধিকারের সীমানাও খণ্ডিত। যখন সমষ্টির অধিকারের কথা ওঠে, তখন সমষ্টিকেও ব্যক্তির আদলে ভেবে নেওয়ার প্রবণতা কাজ করে। ব্যক্তির ইচ্ছে-অনিচ্ছে, আশা-আকাঙ্ক্ষার মতো সমষ্টিরও যেন অবিভাজ্য মন আছে। নানা মত, অস্তিত্বের নানান টানাপোড়েন, এ সব কিছু ছাপিয়ে অখণ্ড মানুষের অধিকার। এই অধিকারের পরিসীমাটিও নিটোল।
অধিকারের সীমানা বাড়িয়ে নেওয়ার লড়াই হয়েছে বার বার। কখনও কালো মানুষ, কখনও নারী, কখনও উপনিবেশের মানুষ এই লড়াই করেছে। সীমানা বেড়েছে। সীমা থেকে গেছে। তাই, অধিকার অর্জনের চেষ্টা সব সময়েই নির্দিষ্ট কোনও স্থান-কাল-পাত্রের নিরিখে সীমায়িত। যদিও তার ভাষা, সর্বত্রগামী হওয়ার ভাষা। এক দিকে সবার জন্য সমান অধিকারের ডাক, অন্য দিকে এক একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তার সীমায়িত রূপ এ দুটোরই প্রয়োজন। কোনও একটা দিক বাদ দেওয়া মুশকিল। কোন অধিকারের কথা বলা হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
আমার শরীরের উপর আমার, নিজের অধিকার এই রকম একটা আপাতসরল ধারণার ভিতরেও কিছু জটিলতা থেকে যায়। কোথায় টানব এই অধিকারের সীমানা, সে প্রশ্ন পুরোপুরি সর্বজনগ্রাহ্য কোনও যুক্তিতে সাজানো যায় না। কতখানি পরিণতমনস্ক হলে নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করা যায়, আইনি ভাবে যৌন সংসর্গ করা চলে তার সঙ্গে, সেটা ঠিক হবে কীসের ভিত্তিতে? কোন বয়সেই বা অর্জিত হয় সে পরিণতি? পরিণতি-প্রাপ্তির ওই যুক্তিই তো অধিকার থেকে বিশেষ বিশেষ কারণে অনেককে বহিষ্কার করার যুক্তি হয়ে দাঁড়ায়। বলা হয় ও বা ওরা অপরিণত, তাই অনধিকারী।
আবার পরিণতির প্রশ্ন পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়াটা চট করে র্যাডিকাল মনে হলেও ক্ষমতা-সম্পর্কের নানান ধরনকে অগ্রাহ্য করার একটা বিপদ এর মধ্যে থাকে। অসমের সমান অধিকার থাকলে সেটা তো ক্ষমতাশালীর পক্ষেই কাজ করে। পরিণতমনস্কতার ভিত্তিতে, অধিকারভেদের যুক্তিতে যদি বহিষ্কারের মতাদর্শ থাকে, তবে সবার সমান অধিকারের যুক্তিতে কাজ করছে ক্ষমতা-সম্পর্ক অস্বীকারের মতাদর্শ। দুটোর কোনও একটাকেই প্রেক্ষিত ছাড়া সার্বিক আদর্শ বলে মেনে নেওয়া যায় না।
বয়সের হিসেব তাই অনেকখানি আপতিক। কোন বয়সে এক জন মানুষ নিজের শরীরের উপর অধিকার পেতে পারে, ঠিক করতে পারে শরীরী সম্পর্কের বিন্যাস, তার কোনও সর্বজনমান্য মান হওয়া সম্ভব নয়। আদালতের যে রায় নিয়ে আলোচনা চলছে, সেখানেও নির্দিষ্ট মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্তটি প্রযোজ্য। একটু খুঁটিয়ে ওই রায় এবং ওই ধরনের আরও কয়েকটি রায়ের যুক্তিপ্রবাহ দেখা যেতে পারে। এই বিশেষ রায়টি একটি মুসলিম মেয়ের ব্যাপারে প্রযোজ্য হলেও একই ধরনের অবস্থান কোর্ট অনেক সময়ে কয়েকটি হিন্দু বিয়ের ক্ষেত্রে নিয়েছে।
বলা হল, নাবালিকা বিয়ে হওয়া অপরাধ, কিন্তু নাকচযোগ্য নয়। বিয়ে এক বার হয়ে গেলে আর ভাঙা যাবে না, যদি মেয়েটি ভাঙতে রাজি না থাকে। আর একটু নমনীয় হয়ে বলা হল, আঠেরো বছর বয়স হলে মেয়েটি মত বদল করে বিয়ে ভাঙতে পারে। নির্দিষ্ট একটি কেসে, মানবিকতার খাতিরে আইনের একটি সার্বজনিক বিধি (নাবালিকার বিয়ে একটি অপরাধ) ঠিক লঙ্ঘন না করা হলেও একটা পরিবর্তিত ভাষ্যের অধীন করা হল। একই ধরনের অন্য কয়েকটি কেসে নানা ভাবে ভাষ্য পরিবর্তনের কাজটি করা হয়েছে। সব ক্ষেত্রে রায় সংশ্লিষ্ট মেয়েটির প্রতি সংবেদনশীল থাকেনি। তবে আইনের সার্বজনীনতা বিশেষ ক্ষেত্রের বিশিষ্টতায় প্রতিসরিত হয়েছে। আইন তো এই ভাবেই কাজ করে।
আবার, আমার অধিকার মানেই কি আমারই অধিকার? যে মেয়েটি জেনেবুঝে সিদ্ধান্ত নিল, পেটের মেয়েটাকে মেয়ে বলেই মেরে ফেলা উচিত, তার সেই সিদ্ধান্ত কি তারই সিদ্ধান্ত? তার মেয়ে-ভ্রূণ হত্যার অধিকার কি তারই অধিকার? সেই আপাত-অধিকারের ভিতরে কি কাজ করে চলে না পরিবার, সমাজ আর পুরুষতন্ত্রের অধিকারের কলকব্জা? (পিতৃতান্ত্রিক) মতাদর্শের কাজ তো নারীর মতকেও তৈরি করে নানা ভাবে। তাই অধিকারের বয়ানে মতাদর্শের বুনটকে স্বীকার করে নারীবাদীকে কাজ করতে হয় কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে (তা সে মায়ের মত অনুযায়ী হলেও)। একই সঙ্গে অধিকারের বয়ানের ভিতরে নিজের শরীরের উপর নারীর অধিকারের স্বীকৃতি চাইতে হয়। এ দুইয়ের ভিতরে বিরোধ নেই কোনও। যুক্তির বিমূর্ত ক্রমে না হলেও, জীবনে দুই বিপরীত মেরুকেই আঁকড়ে থাকতে হয় আমাদের।
সব শেষে আর এক বার মনে করে নিই, এমনকী বয়সের ভিত্তিতে যৌনতা আর শরীরের অধিকারের ছকটাও নারী আর পুরুষের ক্ষেত্রে নাটকীয় ভাবে ভিন্ন হতে পারে। বয়স আঠেরোর কম হওয়ায় হিংস্র ধর্ষণের অপরাধের শাস্তি অনেকখানি কম হয় একটি ছেলের। না-বালকের দায়হীনতা। বয়স আঠেরোর কম হলেও বিয়ের সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকে মেয়েটির। না-বালিকার আগাম দায়িত্ব। এটা কি কোনও সমাজ-গন্তব্যের রূপক?
|
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ কালচারাল স্টাডিজ-এর শিক্ষক |