|
|
|
|
বাড়ি বা পথ, কংক্রিটের দূষণ-জালও নগর জুড়ে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
একটা দোতলা বাড়ি ভেঙে বহুতল উঠবে। সেই ভাঙা-গড়ার জেরে দক্ষিণ শহরতলির এক পাড়ায় প্রায় সব বাড়িরই রং ধুলো-বালিতে কার্যত ‘লাল’ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় আড়াই বছর আগের ঘটনা।
গত শনিবার এয়ারপোর্ট এক নম্বর গেট থেকে অটোয় চেপে নিউ ব্যারাকপুর ফিরছিল একটি পরিবার। কংক্রিটের রাজপথ ভেঙে-চুরে একাকার। তার উপরে রাস্তার ধার জুড়ে চলছে পরের পর বহুতল নির্মাণ। সব মিলিয়ে রাস্তা জুড়ে ধুলোর ঝড়। সিমেন্ট-বালি-সুরকির একটা আস্তরণ যেন ভাসছে গোটা তল্লাটে। ওঁরা যখন বাড়ি পৌঁছালেন, বছর আটেকের বাচ্চাটি তো বটেই, বড়রাও হেঁচে-কেশে একশা। |
|
সঙ্গী যখন দূষণ। বিমানবন্দরের দু’নম্বর গেটের সামনে যশোহর রোডে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক। |
পরিবেশবিদ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, কলকাতার বায়ু-দূষণে পরিবহণ ও শিল্পের ধোঁয়ার সঙ্গে এখন কংক্রিটের ধুলোরও ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। এবং ফি বছর তার প্রকোপ বাড়ছে। বছর পনেরো আগে মহানগরের সার্বিক দূষণে কংক্রিটের অবদান ছিল সাকুল্যে ২%। এখন সেটাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০%। এমনকী, খাস সল্টলেকে মেট্রোর নির্মীয়মাণ কিছু প্রকল্পস্থলে গেলেও এটা হাড়ে হাড়ে মালুম হবে।
আর এর জন্য বিশেষজ্ঞেরা আঙুল তুলছেন নিয়ম-ভাঙা নির্মাণের প্রবণতার দিকে। কী রকম?
পরিবেশবিদেরা বলছেন, অন্যান্য মহানগরের মতো কলকাতাও কলেবরে বাড়ছে। নিত্য দিন মাথা তুলছে নিত্য নতুন বহুতল। কিন্তু সেগুলো বানাতে গিয়ে বহু ক্ষেত্রে পরিবেশ-বিধির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ফলে কংক্রিটের জঙ্গল থেকে এন্তার দূষণ ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) রিপোর্ট দিয়েছে, বায়ু-দূষণের জেরে কলকাতায় ক্যানসারের প্রকোপ বাড়ছে। শহরের চিকিৎসকদের হুঁশিয়ারি, দূষিত বাতাস ক্যানসারের পাশাপাশি হাঁপানি-সহ শ্বাসনালি ও ফুসফুসের নানা রোগ ডেকে আনতে পারে। বস্তুত চিকিৎসকদের তথ্যও বলছে যে, এ শহরে নির্মাণকাজে যুক্ত কর্মী-শ্রমিকেরা ইদানীং এ জাতীয় রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। শ্বাসরোগ বিশেষজ্ঞ পার্থসারথি ভট্টাচার্যের কথায়, “এ ধরনের দূষণ থেকে আর কী কী রোগ হতে পারে, তা নিয়ে এখনও প্রচুর গবেষণার অবকাশ।” |
ধুলোয় বিষ |
• জড়ো করে রাখা ইমারতি দ্রব্য থেকে দূষণ ছড়ায়। |
• নির্মাণকাজ চলার সময় সুক্ষ্ম ধূলিকণা বাতাসে মেশে। |
• ভাঙা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলার সময়ও হাওয়ায় মেশে ধুলো। |
• শহরতলিতে নিত্যনতুন বহুতল গড়ে ওঠায় প্রকোপ বেড়েছে। |
• বেহাল রাস্তার কারণে বিরাটি, মাইকেলনগর, বেহালায় ধুলোর প্রকোপ বেশি। |
• ’৯৬-’৯৭ সালে বায়ুদূষণের ২% ভাগীদার ছিল কংক্রিট দূষণ। এখন তা ২০%-এর কাছাকাছি। |
• এই দূষণ থেকে ক্যানসার, হাঁপানি-সহ ফুসফুস ও শ্বাসনালির রোগ |
|
এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরকারি উদাসীনতাকেও অনেকাংশে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞেরা। “নির্মাণশিল্পের দূষণের কথা তো বছর পাঁচেক আগেই জানা গিয়েছে! তবু এখনও কেন তার রমরমা?” প্রশ্ন তুলছেন ওঁরা। পরিবেশবিদদের একাংশের বক্তব্য, শহরাঞ্চলে নির্মাণকাজ চলাকালীন নির্মাণস্থল ও মজুত ইমারতি সামগ্রীর চারদিকে চট বা ত্রিপল ঢাকা দেওয়ার নিয়ম। অথচ শহরের পরিচিত ছবি বলছে, গুটিকয় সংস্থা ছাড়া এ ভাবে কেউ কাজ করে না। পরিবেশকর্মী নব দত্তের আক্ষেপ, “অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি নির্মাণের ক্ষেত্রে এ সব দিকে নজরই দেওয়া হয় না! ফলে কংক্রিট-দূষণের বাড়বাড়ন্ত।”
কী ভাবে ছড়ায় এই দূষণ?
পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, নির্মাণকাজে যে ভাঙা ইট, সিমেন্ট, বালি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়, চারপাশে ঢাকা না-থাকায় সেই ইট-বালি-সিমেন্টের ধুলো হাওয়ায় ভেসে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। “বায়ু-দূষণের প্রধান উপাদান ভাসমান ধুলিকণা। কংক্রিটের লাগামছাড়া ধুলো তার ভাণ্ডার দিন দিন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে।” মন্তব্য এক পরিবেশ-বিজ্ঞানীর। এর বড় দৃষ্টান্ত বেহালা। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ-সূত্রের খবর: বেহালা শহরতলিতে গত জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা ছিল সহনমাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। |
দূষণ-কর্কট |
কী বলেন ডাক্তারেরা |
প্রশ্ন: বায়ু-দূষণে কীসের কীসের ক্যানসার হতে পারে?
উত্তর: মূলত ফুসফুস, মুখগহ্বর, স্বরযন্ত্র ও খাদ্যনালীর। |
প্রশ্ন: উপসর্গ?
উত্তর: একটানা দেড়-দু’মাস ধরে কাশি। কিছুতেই সারছে না। সঙ্গে হয়তো ছিটেফোঁটা রক্ত। গলার আওয়াজ পাল্টে যেতে পারে। বেশ ক’দিন ধরে ঢোঁক গিলতে অস্বস্তি কিংবা গলায় কিছু আটকে থাকার অনুভূতি বিপজ্জনক। গলায় ব্যথাহীন মাংসপিণ্ড গজিয়ে ওঠা অথবা মুখের ভিতরের ঘা সাধারণ চিকিৎসায় না-সারাটাও ভাল কিছু নয়। |
প্রশ্ন: সাবধান হবে কী ভাবে?
উত্তর: সমস্যা বুঝলেই ডাক্তার। গোড়াতেই ক্যানসারের ডাক্তার দেখাতে হবে, তার মানে নেই। প্রথমে জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাছে যান। তিনি পরামর্শ দেবেন। বেশি ধুলো-ধোঁয়ার জায়গায় মাস্ক পরে থাকা উচিত। ভোরে সবুজের মধ্যে অন্তত আধ ঘণ্টা হাঁটুন। ভোরে সময় না-হলে রাতে, যখন দূষণ-মাত্রা কম থাকে। নিয়মিত ব্যায়াম খুব জরুরি। |
প্রশ্ন: আগাম কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা?
উত্তর: উপসর্গ থাকলে বুকের এক্স-রে, রক্তের হিমগ্লোবিন, টিসি, ডিসি-র মতো সাধারণ কিছু টেস্ট করাতে পারেন। রিপোর্টে গোলমাল পেলে আরও কিছু দরকার। যেমন, যন্ত্রণাহীন মাংসপিণ্ড থাকলে সিটি স্ক্যান বা নিড্ল বায়পসি। |
প্রশ্ন: কখন দূষণ বেশি থাকে?
উত্তর: যতক্ষণ রাস্তায় বেশি গাড়ি চলে। এখন তো সকাল সাতটার পরেই গাড়ি বেড়ে যায়। বড় বড় ডিজেল-গাড়ি দূষণের মাত্রা আরও বাড়ায়। আর শিল্পাঞ্চলে কল-কারখানা চালু থাকলেই দূষণ। বাড়ি ভাঙা বা মেরামতির সময়ও যথেষ্ট দূষণ ছড়ায়। এ সব ক্ষেত্রে মাস্ক আবশ্যিক। |
প্রশ্ন: বিশেষ কোনও খাদ্যাভ্যাস কাজে আসতে পারে?
উত্তর: যাঁদের বাধ্য হয়ে অধিকাংশ সময়ে দূষিত পরিবেশে কাটাতে হয়, তাঁদের খাদ্য তালিকায় প্রাকৃতিক খাবার থাকা দরকার। যেমন ফল, তাজা সব্জি ইত্যাদি। |
|
এর প্রতিকার কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা দেওয়ার চেয়ে বড় দাওয়াই আর কিছু নেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক অমিত দত্ত বলেন, শহরে বা জনবহুল এলাকায় নির্মাণকাজ করতে গেলে তা ত্রিপল কিংবা চটের ঢাকা দিয়ে করাটাই নিয়ম। সঙ্গে জলও ছেটাতে হবে। তাঁর কথায়, “পাথরকুচি কিংবা ইটের পাঁজায় নিয়মিত জল দিলে ধুলো আটকানো সম্ভব। সিমেন্টের বস্তা রাখলে তা অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে।”
তবে এ সবের বাইরে নির্মাণকাজে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারও জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নির্মাণ-বিশেষজ্ঞ পার্থ দাস জানাচ্ছেন, উন্নত দুনিয়ায় দূষণ ঠেকাতে কংক্রিটের ব্যবহার যতটা সম্ভব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। “বিদেশে এখন বহুতল-সহ বড় বড় নির্মাণকাজে কংক্রিটের বদলে ইস্পাত, জিপসাম বা অ্যালুমিনিয়ামের পাত দিয়ে দেওয়াল তৈরি হচ্ছে। তাতে কাজ দ্রুত হচ্ছে, ধুলোর দাপটও কমছে।” বলেন তিনি।
কংক্রিট-দূষণ রোধে সরকারি উদাসীনতার আর এক ছবি বেহাল রাস্তা। যশোহর রোড কিংবা ডায়মন্ড হারবার রোডে গেলেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। দু’টি রাস্তাই দীর্ঘ দিন ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। গাড়ি গেলেই ওঠে ধুলোর ঝড়। ওই রাস্তা দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করা গাড়িচালকেরা জানিয়েছেন, ধুলোর দাপটে হাঁচি-কাশি তো হয়ই, সামনের কাচ পর্যন্ত ঝাপসা হয়ে যায়। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য ল’অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “নির্মাণকাজের জন্য মাটি কেটে ডাঁই করে রাখা হয়। পরে তা শুকিয়ে ধুলোয় পরিণত হয়। হাওয়ার ধাক্কায় তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে।”
বস্তুত রাজ্যের তাবড় পূর্ত-কর্তারা মেনে নিচ্ছেন যে, বাড়ির মতো সেতু বা রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রেও পরিবেশ-সচেতনতা সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কী করছে?
পর্ষদের এক সূত্রের বক্তব্য, এ ব্যাপারে তাঁদের তরফে নজরদারি চালানোর তেমন সুযোগ নেই। এক পর্ষদ-কর্তার দাবি, বিষয়টি পুরসভার মতো স্থানীয় প্রশাসনের এক্তিয়ারে। তবে পুরসভাও যে ঠিকঠাক মতো নজরদারি চালায় না, পুর-কর্তাদের একাংশ তা মেনে নিয়েছেন। কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় জানান, এ নিয়ে পুরসভার নির্দিষ্ট নির্দেশিকা নেই। “যথাসম্ভব ঢাকাঢুকির ব্যবস্থা করে নির্মাণকাজ চালাতে বলা হয়।” মন্তব্য মেয়রের। |
|
|
|
|
|