খাটে মশারিটা যথারীতি খাটানো। এক জনের নিথর রক্তাক্ত শরীর পড়ে রয়েছে খাটের পাশে, মেঝেতে। অন্য জন রাইফেল হাতে সেই ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে। মাঝরাতে ব্যারাকের ভিতরে ওই ঘরের সামনে গিয়ে এমন দৃশ্যই চোখে পড়েছে আচমকা গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়া সহকর্মীদের। ঘটনাস্থল, গার্ডেনরিচে সিআইএসএফ-এর ব্যারাক। সময়, শনিবার রাত দেড়টা।
পুলিশ সূত্রের খবর, রাতে যখন গোটা ব্যারাক ঘুমিয়ে ছিল, তখন সিআইএসএফ-এর কনস্টেবল নীলকান্ত বেহরা গুলি করেন তাঁর সহকর্মী সাব-ইনস্পেক্টর গুরুপদ সীট-কে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত সাব-ইনস্পেক্টর গুরুপদ সীট ওরফে গোবিন্দ (৫৪)-এর বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমায়। অভিযুক্ত নীলকান্তর বাড়ি ওড়িশায়। ঘটনার পরেই তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশের দাবি, নীলকান্ত তাঁর অপরাধ স্বীকার করেছেন। তাই তাঁকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। রবিবার আলিপুর দায়রা আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন। |
কন্ট্রোল রুমে এনে রাখা হয়েছে নিহত এসআই-এর দেহ। রবিবার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য। |
গত বছর ভবানীপুরে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের নিরাপত্তাকর্মীও গুলি করে খুন করেছিলেন ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার এবং আর এক নিরাপত্তা কর্মীকে। ওই দুই সহকর্মীর টিটকিরি সইতে না পেরেই তিনি এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন বলে পুলিশি জেরায় দাবি করেন তিনি। এর আগে ২০০১-এর ফেব্রুয়ারিতেও বিমানবন্দরে রাইফেল থেকে গুলি করে দুই সহকর্মীকে খুন করেন সিআরপিএফ-এর এক জওয়ান।
শনিবার রাতের ঘটনায় সহকর্মী সাব-ইনস্পেক্টরকে কেন মারলেন ওই কনস্টেবল? পুলিশের দাবি, ধৃত কনস্টেবল তাদের জানিয়েছেন, শনিবার সন্ধ্যায় ওই সাব-ইনস্পেক্টরের কাছ থেকে ‘সেন্ট্রি’ হিসেবে ডিউটি বুঝে নেওয়ার সময়ে (রোল কল) তাঁর মোবাইলে একটি ফোন আসে। সেই ফোনে কথা বলার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় তাঁকে গালিগালাজ করেন গুরুপদবাবু। তাঁকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। এতেই চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে তিনি রাতে ওই ঘটনা ঘটান বলে পুলিশকে জানিয়েছেন নীলকান্ত। গুরুপদ ঘুমিয়ে ছিলেন ব্যারাকের রিক্রিয়েশন রুমে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সেখানে চলে যান তিনি। ডেকে তোলেন গুরুপদকে। তাঁদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। এর পরেই আচমকা গুরুপদকে লক্ষ করে নিজের ইনসাস রাইফেল থেকে তিন রাউন্ড গুলি চালান নীলকান্ত।
পুলিশের আরও দাবি, নীলকান্ত অভিযোগ করেছেন, শুধু শনিবারই নয়, অফিসে নানা বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যেই তাঁকে টিটকিরি করতেন গুরুপদ। এমনকী তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে ছুটি দিচ্ছিলেন না। তাই দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের জেরেই তিনি গুরুপদকে খুন করেন। পুলিশ জানিয়েছে, একটি গুলি গুরুপদবাবুর বুকে, অন্য দু’টি তাঁর ডান কাঁধ ও পেটে লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয় তাঁর।
পুলিশ সূত্রের খবর, গত ১৬ অক্টোবর হলদিয়া থেকে গার্ডেনরিচের রামনগরে সিআইএসএফ-র ব্যারাকে ৮৪ জনের একটি দল আসে। নিহত গুরুপদবাবু এবং নীলকান্ত এই দলেই ছিলেন। ভোটের জন্য তাঁদের আজ, সোমবারই ছত্তীসগঢ়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার কথা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরে চাকরিতে যোগ দেন গুরুপদ। মাস ছয়েক আগে তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এক ছেলে কলেজপড়ুয়া। পাথরপ্রতিমায় বাড়ি থাকলেও বছর ছয়েক ধরে তিনি সোনারপুরের বিবেকানন্দনগরে ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। ছুটিতে পাথরপ্রতিমা যেতেন। বর্তমানে তিনি হলদিয়া বন্দরে কর্মরত ছিলেন। তাঁর এমন মৃত্যুর খবরে ভেঙে পড়েছে পরিবার। গুরুপদবাবুর মেয়ে দীপ্তি সীট বলেন, “বাবা কাজেকর্মে খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিলেন। বাবার খুনির কড়া শাস্তি চাই।” |