প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহের পর এল বর্ষা। ঝড়-বৃষ্টি, মেঘলা, মুখ গোমড়া আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটাও বেশ খারাপ খারাপ হয়ে ওঠে। আর এই শহুরে বর্ষা! চারিদিকে জমা জল। ঘরে বসে বসে যেন কয়েক দিনের বন্দি দশা। আর এর পরে কালো মেঘের দল পাড়ি দেয় কোন দিগন্তে। স্বচ্ছ নীল আকাশে এখন সাদা মেঘের দল পাল তুলে ঘুরে বেড়ায়। বাঙালির উৎসবের মরশুম শুরু হয়ে যায় শরৎ এলেই। মেঘের ভেলা ছুঁতেই যেন রংবেরঙের ঘুড়ি ওড়ানোর পালা আসে।
ছোট্ট দীপু আজকাল দেখছি একটু বড় বড় হয়েছে। আমাদের এই আশ্রমের পাশেই তাদের বাড়ি।
মাঝে মাঝে যাওয়া আসার পথে দেখা হয়ে যায়। এই দিন কয়েক ধরে দেখছিলাম খেলাধুলা ফেলে খুব ব্যস্ত সে। কাগজ, আঁঠা, ঘুড়ি, লাটাই— সব নিয়ে গম্ভীর গম্ভীর মুখে কী যেন করে যাচ্ছে একমনে।
ঘুড়ি, লাটাই নিয়ে ওর ব্যস্ততা দেখে আমারও ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। স্কুলের মাঠ, সবুজ ধানখেত, আর তার মধ্যে আলপথ— আকাশে ঘুড়ি উড়ছে, দু’একটা সুতো কাটা ঘুড়ি দুলে দুলে ভাসতে ভাসতে চলেছে। তাকে ধরতে ছুট ছুট। পথ-বেপথে— নজর আকাশে, হয়তো পা হড়কে আলপথে পড়ে গিয়ে জামাকাপড় কাদামাটিতে একাকার। বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি! কখনও বা পাঁচ পয়সার ঘুড়ি কিনে ভাইয়ের সঙ্গে লাটাই নিয়ে বেরিয়ে পড়া— মাঞ্জা দিতে গিয়ে সরু সুতোয় হাত কেটে যাওয়া, আর অন্য ছেলের ঘুড়ি ভোঁ-কাট্টা করে বেজায় খুশি হওয়া। ভাবি, দীপুরা থাকে শহরে, মুক্ত প্রান্তরে ঘুড়ি ওড়ানোর স্বাদ কেমন, ওরা কি জানে?
যা-ই হোক, তাকাই আকাশ পানে। কত্ত রঙের কত্ত ঘুড়ি! মিশনের মাঠে কত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ঘুড়ি নিয়ে মেতে উঠেছে। ওদের হুল্লোড়ের হাতছানিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই ওদের দিকে। দেখি একমনে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে দীপুবাবু। হঠাৎ আমাকে লক্ষ করে বন্ধুর হাতে ওর লাটাই দিয়ে ছুটে আসে, হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। বলে, ‘ও মহারাজ, এসো না, আমার সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াবে। বাবা আমাকে পনেরোটা ঘুড়ি কিনে দিয়েছে। এসো না, এসো না।’ তার বায়না এড়াতে পারি না। ও লাটাইটা আমার হাতে দেয়। আমিও আমার ছেলেবেলা ফিরে পাই আর এক বার। খুশি মনে ওড়াতে থাকি দীপুবাবুর ঘুড়ি। দীপুবাবু অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকে তার মহারাজের ঘুড়ি ওড়ানো। |
আমিও বলি, দেখো দীপু, এই ভাবে সুতোয় টান দেয়, এই ভাবে সুতো ছাড়ে, আর এই ভাবে— ওই দেখো নীল ঘুড়িটাকে এ বার কাটব, লাটাই ধরে প্যাঁচ লাগাই। দীপু বলে, ‘না না মহারাজ, ঘুড়ি কেটো না, কেটো না। কী সুন্দর উড়ছে দেখো, মাথা নেড়ে নেড়ে, লেজটা হাওয়ায় ভাসিয়ে।’ একটু থমকে যাই, অবাকও হই! দীপুবাবুর মুখে এ কেমনতর কথা! ঘুড়ি কেটে তো সবাই আনন্দ পায়। বলি, তুমি না কাটলে অন্যেরা যে তোমার ঘুড়ি কেটে দেবে।
একটু হেসে যেন খুশি হয়ে বলে, দিক গে। আমি তো সেটাই চাই। সে কী, সেটাই চাও, মানে?
দীপু বলে, আমার চারটে ঘুড়ি কেটে দিয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি। একটু হতভম্ব হয়ে বলি, ও তাই! এর পর ছুটে যায় দীপু একটু দূরে ঘাসের উপর রাখা তার রংবেরঙের বাকি ঘুড়িগুলোর দিকে। আমার কাছে নিয়ে আসে। বলে, মহারাজ দেখো, আমি একটা জিনিস করেছি। কী জিনিস? দীপুবাবু একটা একটা ঘুড়ি এগিয়ে দেয় আমার দিকে। দেখি ঘুড়িগুলোর গায়ে ওর ছেলেমানুষি ছবি আঁকা— গাছ, বাড়ি, পাখি, কাশফুল, দুগ্গাঠাকুরের মুখ, নদী, ধানখেত— অপটু হাতের বিচিত্র চিত্র। আর তার মাঝে মাঝে
এ কী! বিস্মিত হয়ে দেখি, স্বামীজির নানা বাণী সাদা কাগজে নিজের হাতের গোটা গোটা অক্ষরে লিখে আঠা দিয়ে লাগানো— ‘মানুষ হও’; ‘বলো, আমি সব করতে পারি’; ‘ওঠো জাগো যত দিন না লক্ষ্যে পৌঁছচ্ছ, থেমো না’; ‘যে অপরের সেবা করতে পারে সেই সর্দার হতে পারে’; ‘বীরের মতো এগিয়ে চলো’; ‘চালাকি দিয়ে বড় কাজ হয় না’ ইত্যাদি। প্রত্যেকটার পরে লেখা স্বামী বিবেকানন্দ। আর তার নীচে ছোট্ট করে লেখা ‘ইতি— দীপু’। যেন ঘুড়ির গায়ে চিঠি পাঠাতে চায় কোনও অজানা বন্ধুকে। এ বার হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আনন্দে চোখের কোল ভিজে ওঠে। আমার এত দিনের বিদ্যে-বুদ্ধি কোথায় যেন হেরে যায়। বুঝি, ওই ছোট্ট ছেলে দীপু ঠিক জায়গায় স্বামীজিকে ধরেছে, হয়তো বা না বুঝেই।
দীপু বলে, দেখেছ, কী সুন্দর না ছবিগুলো? আর স্বামীজির ওই কথাগুলো মা মাঝে মাঝে আমাকে বলে। তাই আমিও লিখে দিলাম ঘুড়ির গায়ে। এ ঘুড়ি যে পাবে সেই আমার বন্ধু হয়ে যাবে। আমার ঘুড়ি কেটে গেলেও বন্ধু যখন ঘুড়িটা পাবে, নষ্ট করতে পারবে না। দীপু পাঠিয়েছে বলে, আর এতে স্বামীজির কথা আছে বলে খুশি হয়ে নিজের কাছে রেখে দেবে।
লাটাইয়ের সুতোয় টান দিতে ভুলে গেছি অনেকক্ষণ। দীপুর এই ঘুড়িটাও স্বামীজির কথা বুকে নিয়ে আলতো হাওয়ায় ভেসে গিয়েছে কখন। কোনও ছটফটে ছেলে নিশ্চয়ই সেটা ধরে ফেলেছে। আর দীপুর ছবি ঘেরা স্বামীজিও পৌঁছে গিয়েছেন তার কাছে। একেবারে নীরবে, সবার অজান্তে। |