হাসপাতালের সুপার পদটি এখন আর চিকিৎসক মহলের কাছে লোভনীয় নয়। বরং এই পদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করছেন চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। এই মুহূর্তে এরই একটা বড় উদাহরণ রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএম হাসপাতাল, গত ছ’মাস ধরে খুঁজেও যে হাসপাতালের সুপার পাচ্ছে না স্বাস্থ্য ভবন। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে খাড়া করা হচ্ছে অধ্যক্ষ পদের টোপ। ভাবা হয়েছে, হাসপাতালের সুপার পদে যাঁরা কাজ করবেন, পরবর্তী সময়ে অধ্যক্ষ পদে আবেদনের ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য বাড়তি নম্বরের ব্যবস্থা করা হবে। স্বাস্থ্যকর্তারা মানছেন, এসএসকেএমই তাঁদের এ কথা ভাবতে বাধ্য করেছে।
কী পরিস্থিতি এসএসকেএমে? মাস তিনেক হতে চলল ওই হাসপাতাল অভিভাবকহীন। প্রাক্তন সুপার তমালকান্তি ঘোষ অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি হয়েছেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। তারও আগে আরও প্রায় তিন মাস তমালবাবুর পদোন্নতি ও সেই সুবাদে বদলি ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁর জায়গায় নিয়োগ করার মতো কাউকে না পাওয়ায়।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, সম্ভাব্য প্রার্থীরা বেশির ভাগই জানান, তাঁরা ‘কাঁটার মুকুট’ পরতে রাজি নন। ‘কাঁটার মুকুট’ কেন? এক প্রাক্তন সুপারের কথায়, “কাঁটা ছাড়া আর কী? দিনে পাঁচ জন মন্ত্রী আর ২০ জন রাজনৈতিক নেতার ফোন। কারও পেশেন্ট ভর্তি করতে হবে, কাউকে ফ্রি বেড দিতে হবে। সে সব সামলাতে না সামলাতেই ইউনিয়নের লোকজনের দাদাগিরি। এত সব ঝামেলা সামলানোর পরেও সুপার পদে থাকার জন্য কোনও বাড়তি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেই। তা হলে যেচে এত ঝঞ্ঝাট কেউ নেবেন কেন?”
বস্তুতপক্ষে, সুপার পদে প্রার্থী পাওয়া নিয়ে এমন নাজেহাল অবস্থা স্বাস্থ্য দফতরে এটাই প্রথম নয়। মেডিক্যাল কলেজগুলির অধ্যক্ষ পদের বহু দাবিদার থাকলেও হাসপাতালের সুপার পদে অনীহা অধিকাংশ চিকিৎসকেরই। তাই সুপারদের যখন পদোন্নতি বা বদলি হয়, তার অনেক আগে থেকেই কাকে সেই পদে বসানো হবে, সেই জল্পনা চালাতে হয়।
যেহেতু পদ শূন্য রাখা চলে না, একাধিক ফাইলে সইসাবুদ থেকে শুরু করে আর্থিক লেনদেনের বিষয়েও সই দরকার হয়ে পড়ে, সেই কারণেই নিয়মরক্ষার জন্য কাউকে না কাউকে পদে বসাতেই হয়। এসএসকেএমেও আপাতত সার্জারি বিভাগের প্রধান বিতান চট্টোপাধ্যায়কে কার্যনির্বাহী সুপারের পদে রাখা হয়েছে। যদিও হাসপাতাল সূত্রে খবর, ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রকেই মেডিক্যাল কলেজের দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি সুপারের দায়িত্বও সামলাতে হচ্ছে।
একসঙ্গে এত প্রশাসনিক ঝক্কি নিতে অসুবিধা হচ্ছে না? প্রদীপবাবু বলেন, “যত দিন না স্থায়ী ভাবে এই পদে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে, তত দিন কাউকে না কাউকে সামলাতে হবেই। তবে প্রার্থী পেতে এতটাই সমস্যা হচ্ছে যে মনে হচ্ছে এ বার হয়তো স্বাস্থ্য দফতরকেও এমন কিছু নিয়মকানুন বা সুযোগ-সুবিধা চালু করতে হবে যাতে এই অনীহাটা এড়ানো যায়।”
কী সেই নিয়মকানুন? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে হলে সুপার পদে নির্দিষ্ট সময় কাজের অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক করা যায় কি না সেটা ভাবা হচ্ছে। তা হলে অন্তত যাঁরা অধ্যক্ষ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা সেই জায়গায় পৌঁছনোর আগে কিছু দিন সুপারের দায়িত্বও সামলাবেন।”
প্রদীপবাবুর মতে, এই ব্যবস্থা চালু হলে সমস্যা অনেকটাই মিটতে পারে। তাঁর কথায়, “সুপার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা যদি অধ্যক্ষ পদের দাবিদারদের বাড়তি পয়েন্ট দিতে পারে, তা হলে তা ইতিবাচকই হবে।”
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের একটা বড় অংশই মনে করছেন, প্রশাসনিক পদে যত ঝক্কি, সেই অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা বলতে কিছুই তেমন নেই। দফতরের এক কর্তা বলেন, “একেই এটা নন-প্র্যাকটিসিং পদ। তার উপরে বেতনেও বাড়তি কিছু পাওয়া যায় না। তা হলে এত দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে কেউ উৎসাহী হবেন কেন? শুধুই বাড়তি পয়েন্ট নয়, বাড়তি অর্থেরও ব্যবস্থা থাকা উচিত।” |