শরৎ পেরিয়ে গেল, তবুও বিদায় নিতে নারাজ বর্ষা!
এ বার বর্ষা এমনই না-ছোড় যে আরও অন্তত এক সপ্তাহের আগে বাংলা ছাড়ার লক্ষণ দেখছেন না আবহবিদেরা। আর এর জেরে উত্তুরে হাওয়ার আগমনও বিলম্বিত হতে পারে বলে তাঁদের ধারণা। এ দিকে, বর্ষা-বিদায়ে বিলম্ব হওয়ায় ইতিমধ্যেই কৃষিতে প্রভাব পড়েছে। এর ফলে আউশ ধান, আখ, পান, মরসুমি ফলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কৃষি দফতর।
আবহবিজ্ঞানীরা বলছেন, গত পাঁচ বছরের মধ্যে চার বছরই অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে বিদায় নিয়েছিল বর্ষা। ২০১০ সালে বর্ষা বিদায় নিতে নিতে অবশ্য অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ গড়িয়ে গিয়েছিল। এ বারও তেমনটাই হতে চলেছে বলে আবহবিদেরা জানান। তবে এক আবহবিজ্ঞানীর কথায়, “২০১০-এ বর্ষা এসেছিল দেরি করে। এ বারে কিন্তু বর্ষা একেবারে ঘড়ি ধরে দক্ষিণবঙ্গে হাজির হয়েছে।”
চলতি বছরে বর্ষা দক্ষিণবঙ্গে হাজির হয় ৮ জুন। নিয়মমাফিক ওই দিনই বর্ষার হাজির হওয়ার কথা। কাঁটায় কাঁটায় আগমন দেখে আবহবিদেরা আন্দাজ করেছিলেন, এ বার হয়তো বিদায়বেলাতেও নিয়ম মানবে বর্ষা। কিন্তু এখনও সে দিব্যি থিতু হয়ে বসে রয়েছে দক্ষিণবঙ্গে।
গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বার বর্ষার চরিত্রও কিছুটা বদলেছে। আবহবিজ্ঞানীরা জানান, আগের বছরগুলিতে মরসুমের শুরুতে (জুন-জুলাই) তেমন বৃষ্টি মেলেনি। বৃষ্টিটা মিলেছিল মূলত অগস্ট-সেপ্টেম্বরে। এ বছর কিন্তু শুরু থেকেই দক্ষিণবঙ্গে মোটামুটি দরাজ হয়েছে বর্ষা। অগস্ট-সেপ্টেম্বরে তা আরও জোরালো হয়েছে।
কৃষি-আবহবিদদেরা বলছেন, এ বছর বরুণদেবের মেজাজ বদলের প্রভাব পড়বে কৃষিতেও। |
কৃষি দফতরের কর্তারা বলছেন, পুজোর আগে হাজির হওয়া নিম্নচাপের জেরে পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। তার কয়েক দিনের মধ্যে ওড়িশা-অন্ধ্র উপকূলে হানা দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় পিলিন। মৌসম ভবনের কৃষি-আবহবিদেরা বলছেন, অক্টোবরের গোড়া থেকেই ঝাড়খণ্ডে অতিরিক্ত বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে পিলিনের প্রভাবে তৈরি হওয়া নিম্নচাপের বৃষ্টিতে ঝাড়খণ্ডের জলাধার উপচে যায়। ডিভিসি-র ছাড়া
জলে প্লাবিত হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের একাংশ। তার ফলে দুই মেদিনীপুর ছাড়াও বর্ধমান, হাওড়া এবং হুগলিতেও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি দফতর সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে পর পর দু’টি নিম্নচাপের জেরে এ রাজ্যে প্রায় ৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষি দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, “ডিভিসি-র জল যে সব এলাকায় ঢুকেছে, সেখানে ধানের ক্ষতি হবে। তবে ঠিক কতটা ক্ষতি হবে, তা জল পুরোপুরি সরে না যাওয়ার আগে আন্দাজ করা কঠিন।” কৃষি দফতর সূত্রের দাবি, চলতি বছরে রাজ্যে আউশ ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬৫ লক্ষ মেট্রিক টন। পিলিন এবং নিম্নচাপের দাপটে ধানের ক্ষতি হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সমস্যা হবে না বলে দাবি করছেন কৃষি দফতরের শীর্ষ কর্তারা। দফতরের এক কর্তার কথায়, “এ বারে ঠিক সময়ে বর্ষা আসায় ধানের ফলন ভাল হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে যাবে ধানের ফলন। কিন্তু দুর্যোগের ফলে লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে ধানের ফলন হবে না।” বন্যার দাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব্জি চাষও। দাম চড়েছে বাজারেও।
বর্ষা বিদায়ে দেরি হওয়ায় প্রভাব পড়বে সর্ষে চাষেও। কৃষি দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, দফতরের এক কর্তার কথায়, “নাগাড়ে বর্ষার জেরে মাটিতে এ বার রস অনেক বেশি থাকবে, যা সর্ষের ভাল ফলনে প্রধান অন্তরায়।” দুই মেদিনীপুর এবং তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির যে সব জায়গায় সর্ষে
চাষ হয়, সেখানে এ বার ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা বলে কৃষি-বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, অক্টোবরের মধ্যে বর্ষা বিদায় নিলে ক্ষতির মাত্রা কিছুটা কম হতে পারে।
কিন্তু কবে বিদায় নেবে বর্ষা? আবহবিদেরা জানিয়েছেন, উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা হাওয়া, বৃষ্টির তীব্রতা ও বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ—এই তিনটি বিষয় খতিয়ে দেখে বর্ষা বিদায়ের পূর্বাভাস দেওয়া যায়। বৃহস্পতিবার আলিপুর আবহাওয়া দফতরের বিজ্ঞানী গণেশকুমার দাস বলেন, “বর্ষা বিদায় নেওয়ার সময় এলে বৃষ্টির তীব্রতা ও বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যায়। উত্তর দিক থেকে হাওয়া বয়ে আসা শুরু হয়।” অন্যান্য বছর অক্টোবরের গোড়াতেই এই বৈশিষ্ট্য নজরে পড়লেও এ বছর তেমনটা হয়নি।
কেন?
আবহবিদেরা জানান, এ বছর অগস্ট-সেপ্টেম্বরে ঘনঘন নিম্নচাপ-ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়েছে। ফলে মরসুমের শেষেও জোরালো বৃষ্টি হয়েছে। তার উপরে পুজোর সময় বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় পিলিনের প্রভাবে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে বর্ষা। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের এক কর্তার কথায়, “এ যেন টেস্ট ম্যাচ! টেল-এন্ডারদের ব্যাটের দাপটে লম্বা হচ্ছে বর্ষার ইনিংস।”
এ দিন উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে অবশ্য আবহবিদেরা জানান, দক্ষিণবঙ্গের পরিমণ্ডলে জলীয় বাষ্প কমতে শুরু করেছে। আগামী কয়েক দিনে বৃষ্টির পরিমাণও
কমবে। এ দিনই উত্তরপ্রদেশের একাংশ থেকে বর্ষা বিদায় নিয়েছে। সাধারণত, উত্তরপ্রদেশে বর্ষা বিদায় নেওয়ার অন্তত এক সপ্তাহ পর দক্ষিণবঙ্গ থেকে বর্ষা বিদায় নেয়। সেই হিসেব অনুযায়ী, দক্ষিণবঙ্গ থেকে বর্ষা বিদায় নিতে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ গড়িয়ে যাবে বলেই আবহবিদদের অনুমান। |