মালপোয়া তৈরির কারিগর নেই, বাজার ধরছে লাড্ডু-কাজু বরফি
ক সময়ে বিজয়া দশমীর সকাল থেকেই নদিয়া রাজবাড়ির ব্যস্ততা চরমে উঠত। প্রতিমা বিসর্জনের ঠিক পরেই অতিথি, অভ্যাগতদের মিষ্টিমুখ করানোর গুরুদায়িত্ব থাকত অন্দরমহলের উপরেই। দশমী বা নববর্ষের মতো বিশেষ দিনে রাজবাড়ির অতিথিদের কাছে যে পদটি সবচেয়ে লোভনীয় ছিল, তা হল ক্ষীরের মালপোয়া।

রানি জ্যোতির্ময়ীদেবীর নিজস্ব রেসিপিতে তৈরি ক্ষীরের মালপোয়া খাওয়ার জন্য ভিড় উপচে পড়ত। রাজপরিবারের বধূ অমৃতা রায়ের কথায়, “ক্ষীরের মালপোয়া তৈরির ফাইনাল টাচটা জ্যোতির্ময়ীদেবী নিজেই দিতেন। ছানা, ময়দা আর ঘরের গরুর দুধে তৈরি সুগন্ধী ক্ষীর খুব ভাল করে মেখে নেওয়া হত। ছানা আর ক্ষীরের পরিমাণই বেশি থাকত। সামান্য সাদা ময়দা মেশানো হত আঁট ধরানোর জন্য। মেশানোর পর কয়েক ঘণ্টা রাখা হত। তার পরে খাঁটি ঘিয়ে ভেজে উষ্ণ চিনির রসে ডুবিয়ে দেওয়া হত। ভাজার আগে ছড়িয়ে দেওয়া হত গোলমরিচ। কিছু ক্ষণ রসে ভিজিয়ে রাখার পরে তুলে রস ঝরিয়ে এলাচ গুঁড়ো ছড়িয়ে পরিবেশন করা হত। আমাদের বাড়িতে এখনও এই ভাবেই মালপোয়া হয়। তবে সে কালে শুনেছি কোনও উৎসবে অতিথি আপ্যায়নের ব্যাপার থাকলে মালপোয়া খাদ্যতালিকায় থাকতই।” শুধু নদিয়া রাজবাড়ি বলেই নয়, সমগ্র নবদ্বীপ জুড়েই মালপোয়ার জনপ্রিয়তা তুলনাহীন। কেউ-কেউ মনে করেন, সেই জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ চৈতন্যদেব। বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী গ্রন্থের লেখকরা বারবার তাঁর খাদ্যাভাসের কথা লিখতে গিয়ে পুলির কথা বলেছেন। সেই পুলি ও মালপোয়া অভিন্ন বলে মনে করেন অনেকে। তবে অন্য মতও রয়েছে। চৈতন্যচরিতামৃতে রয়েছে, পুরী যাওয়ার পরে সার্বভৌম ভট্টাচার্যের বাড়িতে চৈতন্যদেবের ভোজনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ক্ষীরপুলি এবং নারকেল পুলির উল্লেখ রয়েছে। সার্বভৌম ছিলেন নব্যন্যায়ের বিশিষ্ট পণ্ডিত। খাদ্য পরিবেশনের সময়েও তিনি যেন বিদ্যাশৃঙ্খলা মেনে চলতেন। ভোজ্য তালিকায় দেখা যাচ্ছে ডাল, ভাজা, বড়ার পরে আসছে পুলি-জাতীয় খাবার। সেই সঙ্গে পিঠে। তার পরে সরাসরি মিষ্টি ও পায়েস। অর্থাৎ ‘মেন কোর্স’ এবং ‘ডেজার্ট’-এর মাঝে থাকত পুলি। তারও আগে শান্তিপুরে অদ্বৈতাচার্যের বাড়িতে একই ক্রমে খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল চৈতন্যদেবকে।
সাধারণ ভাবে বৈষ্ণব সমাজেই মালপোয়া খুব পছন্দের খাবার ছিল। সুকুমার সেন জানিয়েছেন, ‘এই মিষ্টান্নটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ষোড়শ শতাব্দী থেকে। বৈষ্ণবদের মহোৎসবে মালপো থাকবেই।” (শারদীয়া যুগান্তর, ১৩৯০) কিছু অভিধানে মালপোয়া শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘মল্ল’ শব্দ থেকে এর উদ্ভব। ‘মল্ল’ অর্থাৎ চমৎকার এবং ‘পুপ’ মানে রুটি। সেই মল্লপুপ থেকে হিন্দিতে মালপুবা, মরাঠিতে মালপুরা এবং বাংলায় মালপোয়া বা মালপো। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্প াদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “যত দূর জানা যায়, চতুর্দশ শতাব্দীতে বৃন্দাবন-সহ উত্তর ভারতে মালপোয়া প্রচলিত ছিল। পরে যখন চৈতন্যদেবের হাত ধরে তা বৈষ্ণবদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়, তখন ভোজনরসিক বাঙালি তাকে নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্বাদে বদল ঘটাল।”
নবদ্বীপ তথা নদিয়ার অন্যতম প্রবীণ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী শিবু সেন বলেন, “চার-পাঁচ রকমের মালপোয়া হয়। শুকনো মালপোয়া, ক্ষীরের মালপোয়া, সুজির মালপোয়া এবং ছানার মালপোয়া। এর মধ্যে শুকনো মালপোয়াকে রসে ডোবাতে হয় না।” ৮৫ বছরের শিবুবাবুর কথায়, “১৯৪৫ সাল থেকে মিষ্টির ব্যবসা করছি। আমাদের ছোটবেলায় নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে উৎসব মানেই ছিল মালপো বিতরণ। সমাজবাড়ি, গম্ভীরামঠ, সোনার গৌর, জগন্নাথবাড়ি, মহাপ্রভুবাড়ি প্রতিটি মন্দিরের মালপোয়ার নিজস্ব স্বাদ ছিল। ১৯৬২ সাল থেকে মালপোয়া দোকানে বিক্রি করছি। তখন ছিল দু’আনা করে, আর এখন পাঁচ টাকা!”
নবদ্বীপের প্রায় সব মিষ্টির দোকানেই মালপোয়া বিক্রি হয়। তবে এখন যেন তা কিছুটা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। তার জায়গায় শুকনো লাড্ডু কিংবা বরফি বেশি পছন্দ করছেন কিছু মানুষ। মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী থেকে প্রবীণ নাগরিকেরা অনেকেই বলছেন, “বাড়িতে মালপোয়া তৈরির লোক কোথায়? তার থেকে শুকনো লাড্ডু বা কাজুর বরফি অনেক দিন ঘরে রেখে দেওয়া যায়।” এই মন-বদল ঠেকাতে মালপোয়ার কিছু পরিবর্তন কি সম্ভব? অসহায় শোনায় নবদ্বীপের আর এক প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী রামকৃষ্ণ ঘোষের গলা “কী করে ঠেকাবেন? দক্ষ কারিগরের খুব অভাব। যে কারণে বাড়িতে মালপোয়া তৈরি হয় না, সেই একই কারণে আমরাও ক্রমশ মালপোয়া তৈরির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। সেই জায়গায় অনিবার্য ভাবেই উঠে আসছে ভিন রাজ্যের শুকনো মিষ্টি।”
অভিজ্ঞ শিবু সেন বলছেন, “রস আর জালের তারতম্যে লুকিয়ে আছে মালপোয়ার বৈশিষ্ট্য। তাকে শুকনো করা অসম্ভব।” তা হলে কি মালপো এক দিন হারিয়ে যাবে? রসনা-বিলাসীরা বলছেন, তেমনটা বোধ হয় হবে না। বৈষ্ণব পুজো-পার্বণে মালপোর স্থান থাকবেই। আর সেই সূত্রেই অন্তত টিকে যাবে নবদ্বীপের সাধের মালপোয়া।

—নিজস্ব চিত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.