ধনলক্ষ্মীর বন্দনা সুতাহাটার গ্রামে
কৃষিজ সম্পদে ঐতিহ্যশালী হওয়ায় জন্য কয়েক দশক আগে লক্ষ্মীর আরাধনায় মেতেছিলেন তৎকালীন কৃষিনির্ভর হলদিয়া মহকুমার সুতাহাটা ব্লকের কিসমৎ শিবরামনগর ও চাউলখোলার অধিবাসীরা। সেই হলদিয়া এখন মূলত শিল্পাঞ্চল। নয়ের দশকে জমি অধিগ্রহণ শুরুর প্রথম দিকে জমি হারানোর ‘ভয়ে’ গ্রামবাসীরা কৃষিলক্ষ্মীকে আরাধনা করতে শুরু করলেন ভূমিলক্ষ্মী হিসাবে। অধিগৃহীত জমিতে কারখানা গড়ে ওঠা, না ওঠা কারখানায় কাজ পাওয়া, না পাওয়ার দোলাচলে সেই ভূমিলক্ষ্মীই তাঁদের কাছে পুজো পেতে শুরু করলেন ধনলক্ষ্মী রূপে। কারণটা আর কিছুই নয়, জমি ‘হারিয়ে’ সেই কারখানায় কাজের আশা। ক্রমশ, দেবীর এই ধনলক্ষ্মী রূপই ঐতিহ্য হয়ে দাড়িয়েছে সুতাহাটার ওই দুই গ্রামে। এমনকী গ্রাম দুটির লৌকিক নামও ‘লক্ষ্মীগ্রাম’। বাড়ি বাড়ি পুজোর পাশাপাশি ক্লাবগুলিও জৌলুসের সঙ্গে পুজো করায় এই পুজো এখন রূপ নিয়েছে চারদিনের সর্বজনীন উৎসবে। এই পুজোয় যোগ দিতে এখন শিল্পশহর পা বাড়ায় লক্ষ্মীগ্রামে।
বিনয়ী সঙ্ঘের মণ্ডপ তৈরির কাজ চলছে। —নিজস্ব চিত্র।
স্থানীয় দেভোগ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তথা ধনলক্ষ্মীর আরাধনায় ব্রতী অগ্রনী ক্লাবের সদস্য গোকুলচন্দ্র মাজি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, “পরিবেশ-পরিস্থিতিতেই আমরা মনে মনে দেবীর এই রূপান্তর ঘটিয়েছি। প্রতিমা, মণ্ডপ, আলোকসজ্জা সামাজিক কর্মসূচি সব কিছুতেই আমারা গ্রামবাসীরা মিলে শিল্পশহরের বিশ্বকর্মা বা দুর্গাপুজোর সঙ্গে সমানে টক্কর দিতে পারি। আমাদের কাছে লক্ষ্মীপুজোই শ্রেষ্ঠ উৎসব। বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই করি।” অগ্রনীর ৫৭ বছরের পুজোয় এ বার ঝিনুকের মণ্ডপ ও প্রতিমা। সমসাময়িক পুজো সমন্বয় ক্লাবেরও। তবে বর্ষার জন্য তাদের পুজোয় জৌলুস কমেছে এ বার। রাজস্থানী লোক আঙ্গিকে প্রতিমা তৈরি হয়েছে তাঁদের। সম্পাদক সুব্রত মাইতি বলেন, “কর্মসূত্রে গ্রামের যাঁরা ভিনরাজ্যে থাকেন, তাঁরা দুর্গাপুজোয় বাড়ি না এলেও লক্ষ্মীপুজোয় আসেন। এই পুজোতেই গ্রামবাসী পড়েন নতুন পোশাক।” পুজোর ৩৭তম বছরে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি সঙ্ঘের পুজোয় ৭৫ ফুটের উচ্চতার মণ্ডপ হয়েছে মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরের আদলে। বাজেট আড়াই লক্ষ টাকা। থাকছে আলোকসজ্জা। উৎসব কমিটির সম্পাদক সুকুমার শাসমল, কমিটির সদস্য হারাধন দোলাই, তারাপদ মণ্ডলদের কথায়, ১৫ অগস্ট থেকেই তাঁরা ঘটপুজোর মাধ্যমে পুজোর প্রস্তুতি শুরু করে দেন। ক্লাবগুলির মধ্যে থাকে সুস্থ প্রতিযোগিতা। পুজোর চার দিনে লক্ষাধিক মানুষের ভিড় হয়। মেলা বসে। তাঁদের হিসাবে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় পঁচিশটি পুজো হয় দুই গ্রামে।
মেলার মাঠে মণিহারি, খাবার, গ্রামীণ নানা জিনিসের পসরা নিয়ে দোকান দিয়েছেন দিলীপ প্রধান, প্রদীপ দিণ্ডা, গুরুপদ দাসরা। দিলীপ প্রধানের কথায়, “প্রতি বছরই আমরা দুর্গাপুজোয় বিভিন্ন জায়গায় দোকান দিই। কিন্তু এখানে প্রতি বছর আসা চাই। এখানকার আমেজটাই আলাদা। তা ছাড়া বিক্রিবাটাও ভাল হয়।” সুতাহাটা ব্লকের বিনয়ী সঙ্ঘের পুজো এ বার ৫৭তম বর্ষ। কাল্পনিক মন্দিরের আদলে সুউচ্চ মণ্ডপে ১৮ ফুট উচ্চতার ও ১৮ হাতের মহালক্ষ্মীর আরাধনায় মাতবেন তাঁরা। কমিটির অন্যতম কর্মকর্তা শম্ভু ভৌমিক বলেন, “আগে শষ্যগোলা পূর্ণ করার কামনায় গ্রামে একটি মন্দির কেন্দ্রিক পুজো করতেন প্রবীনরা। পরে জমি অধিগ্রহণ ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নে দেবীর কাছে মানুষের কামনারও বদল ঘটেছে। উৎসবের উদ্দীপনার পাশাপাশি এই কারণেও নতুন প্রজন্ম সামিল হচ্ছে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনায়।’’
স্থানীয় সূত্রে খবর, নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কিসমৎ শিবরামনগর, শোভারামপুর, তেঁতুলবেড়িয়া, কসবেড়িয়া গ্রামের জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। সেই জমি দেওয়া হয় শিল্পসংস্থা আইপিসিএল, ক্যালস রিফাইনারি, সাইনো স্টিল, ইসিএল, শিবম গ্যাস প্রভৃতিকে। তাদের কোনও কোনওটা চালু হয়েছে, আবার কোনটি চালুর পথে। তবে, সীমানা প্রাচীরেই সীমাবদ্ধ রয়েছে কয়েকটি। জমিদাতা অশোক বেরা, সুখেন্দু রাজ পণ্ডিত, হারাধন ফদিকার, লক্ষ্মীকান্ত ভৌমিকরা বিভিন্ন পুজো কমিটির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের বক্তব্য, বাবা-কাকারা কৃষির জন্যই দেবীর পুজো শুরু করেছিলেন। আমরা হাল ধরেছিলাম জমির মূল্য বুঝে জমি রক্ষা করার কামনায়। এখন আমাদের কৃষিজমি নেই। কেউ ছোট ব্যবসা, তো কেউ কারখানায় কাজ করেন। আমাদের আশা কারখানাগুলি চালু হলে ধনলক্ষ্মীর কৃপায় কাজের সুযোগ পেয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারবে গ্রামের ছেলেরা। নতুন প্রজন্মের কৃষ্ণ চক্রবর্তী, সমরেশ বেরা, অনুপম বেরারা জানান, “দেবীর কাছে একটাই প্রার্থনা দেবী যেন আমাদের ধান বা ভূমি থেকে নয়, অর্থ থেকে বঞ্চিত না করেন।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.