|
|
|
|
জল নামলে এক ইঞ্চি রাস্তাও কাঁচা
থাকবে না, আশ্বাস পঞ্চায়েত মন্ত্রীর |
বরুণ দে • দাসপুর |
সবে জল নামতে শুরু করেছে। গ্রামবাসীরা ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। রাস্তায় খানাখন্দ। জল নামলে রাস্তার কঙ্কালসার দশাটা বেরিয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে বন্যা বিধ্বস্ত দাসপুরে এসে রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় আশ্বাস দিলেন, “জল নেমে গেলে এক ইঞ্চি রাস্তাও কাঁচা থাকবে না। সব পিচের হবে। জেলায় পরিকল্পনা হবে। আমার দায়িত্ব অর্থ জোগান দেওয়া। আমি সব রকম চেষ্টা করব।” বুধবার দুপুরে নৌকো চেপে দাসপুরের বন্যা পরিস্থিতি
খতিয়ে দেখেন তিনি। জানান, “শুধু আমার দফতর দিয়েই আপনাদের জেলাকে সাজিয়ে দেওয়া যায়। যেখানে ১৭টি প্রকল্প রয়েছে। কোনওটায় রাস্তা
তৈরি হতে পারে। কোনওটায় পানীয় জল প্রকল্পের কাজ হতে পারে।” কালীপুজোর পর ফের জেলা সফরে আসবেন বলেও জানিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী।
বুধবার রাতে মেদিনীপুর সার্কিট হাউসে ছিলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার সকাল দশটা নাগাদ বেরোন বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে। ঠিক ছিল, সুব্রতবাবু কেশপুরে গিয়েও জলমগ্ন এলাকা পরিদর্শন করবেন। কিন্তু, মেদিনীপুর থেকে সড়ক পথে কেশপুরের জলমগ্ন এলাকায় পৌঁছনো যাচ্ছে না। তাই ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে পাঁশকুড়া, মেছোগ্রাম হয়ে প্রথমে পৌঁছন ঘাটালে। ঘাটালের পিএইচই’র গেস্ট হাউসে এক বৈঠক করেন। |
|
ঘাটালে সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
এলাকার কী পরিস্থিতি, কী ভাবে ত্রাণ বিলির কাজ চলছে, সমস্ত কিছু জানেন। ছিলেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়, মহকুমাশাসক অদীপ রায় প্রমুখ। পরে এখান থেকে রওনা দেন ঘাটাল পঞ্চায়েত সমিতির অফিসের উদ্দেশে। ঘাটালের ২ নম্বর চাতাল এখনও জলমগ্ন। ফলে, সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নৌকায় চেপে কিছুটা জলপথ বেরিয়ে ফের চাতালের ওপাশে গাড়িতে ওঠেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। আগে থেকেই ঘাটাল পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে জড়ো হয়েছিলেন দুর্গতরা। এঁদের ত্রাণ বিলি করেন মন্ত্রী। এখানেও একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেন। সুব্রতবাবু বলেন, “এখানে এসেছি শুধু পরিস্থিতি দেখতে নয়। দেখে কী করতে হবে, তার ব্যবস্থা করার জন্য। বুধবার সন্ধ্যায় কোলাঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আমিও ছিলাম। প্রথমে ত্রাণটা জরুরি। সব দুর্গত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এ বার প্যাকেট বিলি শুরু হয়েছে। যেখানে থাকছে চাল, আলু, চিঁড়ে, গুড়, মুড়ি। আগে কখনও এ ভাবে ত্রাণ বিলি হয়নি।” তাঁর কথায়, “এত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা সব রকম ভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। মাস্টার প্ল্যান ছাড়া ঘাটাল বাঁচবে না। বিকল্প নেই। বুধবারের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মাস্টার প্ল্যান প্রস্তুত করে যেন তাঁর কাছে জমা দেওয়া হয়। এটাও একটা ইতিহাস!” ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কার্যকর করতে রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়েছে বলেও মন্ত্রীর দাবি। ২ নম্বর চাতালের উপর নতুন সেতু তৈরি হবে বলেও জানান মন্ত্রী। তাঁর কথায়, “বুধবারের বৈঠকে এ নিয়েও আলোচনা হয়। সেতু তৈরির জন্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে। ঘাটালকে রাতারাতি বাঁচাতে পারলাম না। তবে, ভবিষ্যতে যাতে বাঁচতে পারে, তার সব রকম চেষ্টা চলছে। চারিদিকে জল। এটা ভয়াবহ চিত্র। এটা স্থায়ী হতে পারে না। বরং সমস্যা সমাধানের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। আজ শুধু বলছি, আমাদের উপর আস্থা রাখুন।” মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন ঘাটালের বিধায়ক শঙ্কর দোলুই, দাসপুরের বিধায়ক মমতা ভুঁইয়া, জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ শ্যাম পাত্র, সদস্য বিবেক মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
জেলার অন্যত্র জল নামলেও ঘাটালে বন্যা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। ঘাটাল পুর এলাকা-সহ ব্লকের ৮৪টি গ্রাম এবং দাসপুর-১ ব্লকের নাড়াজোল ও রাজনগর পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও জলের তলায়। বালিপোতা গ্রামে কংসাবতী নদীর বাঁধ ভেঙে দাসপুরের ওই দু’টি পঞ্চায়েতের প্রায় ৩০টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চন্দ্রকোনা-১ ও ২ ব্লকের গ্রামগুলি থেকে অবশ্য জল নামতে শুরু করেছে। ঘাটালের মহকুমাশাসক অদীপ রায় বলেন, “মহকুমার সব নদীর জল রূপনারায়ণে গিয়ে মেশে। ডিভিসি জলাধার থেকে জল ছাড়ায় ওই নদীতে জলের বাড়ছে। ফলে, শিলাবতী, কংসাবতী, ঝুমি-সহ অন্য নদীর জল স্বাভাবিক গতিতে গিয়ে মিশতে পারছে না। তাই ঘাটালের নানা এলাকার জল কমছে না।” এ দিন ঘাটালে দুর্গতদের ১০ কিলো চাল, ৫ কিলো আলু, চিঁড়ে, গুড় এবং শিশুদের জন্য ২০০ গ্রাম দুধের প্যাকেট বিলি শুরু হয়েছে। ঘাটালের বিডিও সঞ্জয় পণ্ডিত বলেন, “আমরা মোট ৩০০ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে এই প্যাকেট দেব।” |
|
জলমগ্ন দাসপুরের রাজনগর। |
এ দিন দুপুরে ঘাটাল মহকুমাশাসকের অফিসে আসেন তিনি। এখানেও দুর্গতদের ত্রাণ বিলির আয়োজন করা হয়। এরপর দাসপুরের উদ্দেশে রওনা দেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার দিনভর মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ছন্দবানী মুখোপাধ্যায়। ঘাটালের বিধায়ক শঙ্করবাবু বলছিলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অবহেলা। এ সব ঘাটালে নতুন কিছু নয়। আমরা ব্যাঙ্গ করে বলি, ঘাটালের বন্যা ঘরজামাই। বন্যা দেখতে এই প্রথম কোনও মন্ত্রী ঘাটালে এলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে স্বপ্ন দেখেছেন। মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এবং স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছেন। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে মাঝেমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী-সেচমন্ত্রী খোঁজখবর নিচ্ছেন। আজকের দিনটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।” তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আমরা পাহারাদার। মানুষ বিপদে পড়লে পাহারা দেবো।” ঘাটাল, দাসপুর মিলিয়ে ১৬টি নলবাহী পানীয় জল প্রকল্পের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে বলে এদিন সুব্রতবাবু জানান। এ জন্য ব্যয় হবে ৩২ কোটি টাকা। জল কমলে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি। বালিপোতায় বাঁধ ভেঙে দাসপুর- ১ ব্লকের বহু গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এদিন দুপুরে এই এলাকা পরিদর্শন করেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। শুরুতে ঘাটাল থেকে পৌঁছন রাজনগরে। এরপর থেকে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই নৌকায় চেপেই পৌঁছন নিজ নাড়াজোলে। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। স্থানীয় এক প্রাথমিক স্কুল ক্যাম্পাসে ত্রাণ বিলির আয়োজন করা হয়। পঞ্চায়েতমন্ত্রী বলছিলেন, “এ বার পরিস্থিতি পুরো আলাদা। রাজ্য সরকার সব রকম ভাবে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী উদ্যোগী হয়েছেন। মানুষ অনেক অনুরোধ করছেন। কী কী করতে হবে বলছেন। কিন্তু, জেলায় এসে কোথাও বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়নি। আমরা তো তৈরি হয়েই আসি, বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে গেলে মানুষ ক্ষোভ জানাবেন। কিন্তু, এ বার তেমন পরিস্থিতি হয়নি।” তাঁর কথায়, “প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করে ঘাটালের মানুষ বেঁচে আছেন। আশা করব, শীঘ্রই সুদিন ফিরবে ঘাটালে।”
সুশান্ত জানা, শ্রীমন্ত বেরা, সাবিত্রী দোলুইরা এখন ওই দিনটারই অপেক্ষায়। বৃহস্পতিবার যাঁরা মন্ত্রীর হাত থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন। যে ত্রাণের প্যাকেটে রয়েছে ১০ কেজি চাল, ৫ কেজি আলু, ১ কেজি চিঁড়ে, ৫০০ গ্রাম গুড়, ৫০০ গ্রাম মুড়ি। সাবিত্রীরা বলছিলেন, “বছরে দু’-তিন বার বন্যা। এ ভাবে কী বাঁচা যায়!” |
|
|
|
|
|