নানা কারণে গঙ্গা, ভাগীরথী ও হুগলি নদীর বুক মজে গিয়ে নাব্যতা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভৈরব, চূর্ণি, জলঙ্গি, মাথাভাঙা, কানা ময়ূরাক্ষী নদীর বুকে দুর্গাপ্রতিমার নিরঞ্জনের নামে তাৎক্ষণিক ভাবে জল দূষণ ঘটছে। দুই জেলা জুড়ে ওই অপকর্মে লাগাম দেওয়ার জন্য প্রশাসনিক স্তরে কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে বটে! তবে সেই সব নিয়ম রূপায়ণ ততটা হচ্ছে না।
নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, “নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জন করাটাই উচিত নয়। গঙ্গাকে যদি মা-ই বলি তবে তাকে দূষিত করব কেন? এ ক্ষেত্রে কলকাতা করপোরেশনের মডেলটাই সবার অনুসরণ করা উচিত। ওখানে ফুল, বেলপাতা কখনও জলে ফেলতে দেওয়া হয় না। কাঠামো জলে ফলার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেন দিয়ে তুলে ফেলা হয়। চন্দননগরেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। গোটা রাজ্যে ওই নিয়ম মেনে প্রতিমা নিরঞ্জন করা উচিত। এসব ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের এগিয়ে আসা উচিত।” ওই বোধের অবশ্য দেখা মেলেনি গ্রাম বাংলার পুরসভা ও পঞ্চায়েতের পুজো কর্তাদের মধ্যে।
নবাব আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কেম্পানির আমলে ভাগীরথীর পাড় বরাবর উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি ভাবে বহরমপুর শহর গড়ে ওঠে। কলকাতা বন্দরে জাহাজ যাতায়াতের প্রয়োজনে ওই নদীর নাব্যতা বাড়নোর জন্য ফরাক্কায় গঙ্গার পাড় থেকে আহিরণ পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার খাল খনন করা হয় ১৯৭৪ সাল নাগাদ। তারপর সেই ফিডার ক্যানালটি মিলিয়ে দেওয়া হয় আহিরণে ভাগীরথীর সঙ্গে। নিম্ন অববাহিকায় ওই ভাগীরথীরই নাম কোথাও গঙ্গা, কোথাও হুগলি। সেই নদীর দু’পাড়ে প্রতি বছরের মতো এ বছরও কয়েক হাজার দুর্গাপ্রতিমার নিরঞ্জন হয়েছে। বহরমপুর শহরেই পুরসভা অনুমোদিত বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয়েছে ১৭৩টি। |
এ ছাড়াও রয়েছে পারিবারিক ও মন্দির মিলিয়ে আরও শ’ দেড়েক পুজো। অর্থাৎ বহরমপুর শহরের ভাগীরথীর ১৭টি ঘাটে প্রায় সোয়া তিনশো পুজোর সপরিবার দুর্গা, অসুর, মহিষ, তাঁদের বাহন ও সঙ্গী মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়েছে।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দুষণ রোধের জন্য পুরসভা নির্দ্ধারিত নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করা হয়নি। বহরমপুরের পুরপ্রধান নীল রতন আঢ্য বলেন, “প্রতিমা নিরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গেই বাঁশ-কাঠের তৈরি কাঠামো নদী থেকে তুলে নেওয়ার জন্য পুজো কমিটির কর্তাদের আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফুল, বেলপাতা জাতীয় পুজোর উপাচার নদীতে না ফেলা হয় তার জন্য ১৭টি ঘাটেই পুরসভা থেকে রাখা হয়েছে আবজর্না ফেলার ভ্যাট। সেখানেই ওই সব উপাচার ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ অমান্য করলে জরিমানা করা হবে বলেও ঘোষণা করা হয়েছে।”
কাঠামো তুলে নেওয়ার ওই নির্দেশ অনেক ক্ষেত্রে মানা হয়েছে। কেবল কৃষ্ণনাথ কলেজ ঘাট আর ভৈরবতলা ঘাটের জলে বৃহস্পতিবার দুপুরেও দেখা গিয়েছে বেশ কয়েকটি কাঠামো ভেসে থাকতে। কিন্তু এ দিন দুপুরে ১৭টি ঘাটের একটিতেও কোনও ভ্যাট চোখে পড়েনি। ফলে উপাচার ফেলা হয়েছে নদীর বুকে। পুরপ্রধান বলেন, “কেন এমনটা ঘটেছে তা খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
একই দশা জঙ্গিপুর, ধুলিয়ান, জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ও মুর্শিদাবাদ মিলে ভাগীরথীর পাড় লাগোয়া আরও মোট ৪টি পুরসভা এলাকায়। পুরসভা থেকে প্রতিমা নিরঞ্জনর ঘাট নির্দিষ্ট করে না দেওয়ার কারণে নদীতে দূষণ ঘটেছে বলে নিজেই স্বীকার করেছেন জঙ্গিপুরের পুরপ্রধান মোজাহারুল ইসলাম। পুরপ্রধান বলেন, “সব প্রতিমাই ভাগীরথীর বিভিন্ন ঘাটে বির্সজন দেওয়া হয়েছে। বুধবার কিছু কাঠামো নদী থেকে তোলা হয়েছে। বাকি কাঠামো শুক্রবার তোলা হবে।’’ পুরপ্রধান বলেন, “বির্সজনের জন্য নির্দিষ্ট কোনও ঘাট না থাকায় ওই কাণ্ড হয়েছে। ভবিষ্যতে নিরঞ্জনের ঘাট নির্দিষ্ট করা হবে।” ইসলামপুরে ভাগীরথীর জলে ১৯টি পুজো কমিটির প্রতিমা ও পুজোর উপাচার বির্সজন দেওয়া হয়েছে। নদী থেকে একটিও কাঠামো তোলা হয়নি। পুজো কর্তাদের দাবি, কাঠামো তুলবেন কালীপুজোর আগে। পঞ্চায়েতও এ ক্ষেত্রে নীরব দর্শক মাত্র।
কৃষ্ণনগরের কদমতলা ঘাটে গত ২ দিনে প্রায় ৮০টি প্রতিমা নিরঞ্জন হলেও বৃহস্পতিবারের আগে নদী থেকে কাঠামো তুলে ফেলার কাজই শুরু হয়নি। ফুল বেলপাতাও ফেলা হয়েছে নদীতে।
বাঁশ-কাঠ নেওয়ার জন্য কেউ কেউ কাঠামো তুললেও তার গায়ে জড়িয়ে থাকা খড় ও পোশাক খুলে নদীতেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ভাগীরথী, মাথাভাঙা, চূর্নী, জলঙ্গি নদীর একই অবস্থা। কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান অসীম সাহা বলেন, “কলকাতা করপোরেশনের মতো আমাদের পরিকাঠামে নেই। ফলে মানুষকে কাজে লাগিয়ে কাঠামো তুলতে হয়। বৃহস্পতিবার থেকে সেই কাজ শুরু হয়েছে।” |