প্রবন্ধ...
রাস্তা সারানোর জন্য যা করা দরকার
প্রায় এক শতাব্দী আগে দুর্বিষহ ট্রেন যাত্রার বর্ণনা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘রস রক্ত যদি হত দই তাহলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই প্রাণটা তার থেকে মাখন হয়ে ছেড়ে বেরিয়ে আসত।’ ২০১৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ওই লাইনটির ভাব সম্প্রসারণে পড়ুয়াদের দল অনায়াসে লিখে ফেলবে কলকাতায় বাইপাস থেকে শুরু করে ডুয়ার্স যাত্রার তরঙ্গায়িত পথের দুঃস্বপ্নের বিচিত্র মুহূর্তগুলো কেল্লা দেখতে যাওয়া জটায়ুর স্পাইনাল কর্ডের ব্যথা, ধুলোর ঝড়ে হাঁপানির টান, অ্যাক্সেল ভাঙা বাসের অবসন্ন দেহ, বাস মালিকের জেহাদ, দোমড়ানো-মোচড়ানো সুমোর উইন্ডস্ক্রিনে জমে থাকা রক্তের দাগ, দু’ঘণ্টা খরচ করে আধ ঘণ্টার পথ পেরোনোর খুড়ির কল, জিভ বের করা টায়ারের অর্ধেক আয়ু, ফার্স্ট গিয়ারের চাপে কার্বন পোড়া গ্যাস ক্রমশ যেন পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওই দুঃস্বপ্ন, এই ফেসবুক টুইটারের যুগেও।
শের শাহ থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ী হেঁটে গেলেন বটে, কিন্তু দেশের তথা বাঙালির সড়কযন্ত্রণা ঘুচল কই? চার-চারটে দেশের বর্ডার আর আটটা রাজ্যের অর্থনীতির ধমনী এ রাজ্যের জাতীয় সড়কগুলি। অথচ, রাজনীতি-অর্থনীতি-প্রযুক্তি-জমিজটের ককটেলে অবরুদ্ধ এই বেহাল সড়ক ব্যবস্থা।
সড়কের ঘনত্বের বিচারে এ দেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম। এমনকী মার্কিনিদের চেয়ে এক কাঠি উপরে। কিন্তু এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাস্তাই পিচ-বিহীন, সব ঋতুতে ব্যবহার-উপযোগী নয়। ফলে কার্যকর রাস্তার ঘনত্ব এ দেশে খুবই কম। সেই নিরিখে পৃথিবীর শেষ কয়েকটা দেশের তালিকায় আমরা রয়েছি। আমাদের দেশে মোট রাস্তার দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৪২,৪৫,২৬৫ কিমি., যার মধ্যে জাতীয় সড়ক ১.৫%, রাজ্য সড়ক ৩.৮%, জেলা সড়ক ৬০.৭১% আর গ্রামীণ সড়কের পরিমাণ হচ্ছে ৩৩.৭৬%। আবার জাতীয় সড়কের ৫১% দুই লেনের, ২৬% এক লেনের আর ২৩% হল চার লেনের।
জনঘনত্বের নিরিখে আমাদের রাজ্য দেশের একেবারে উপরের দিকে। ঠিক একই ভাবে সড়কের ঘনত্বের নিরিখে এ রাজ্য দেশে দ্বিতীয়। কিন্তু জনঘনত্ব ও সড়ক ঘনত্বের পারস্পরিক কাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক এখনও এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে গত দু’দশকে এ রাজ্যের সড়ক ব্যবস্থার অগ্রগতি এই ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করলেও, মাথাপিছু সড়কের দৈর্ঘ্যের নিরিখে আমরা দেশের বেশ কিছু বড় রাজ্যের তুলনায় খানিকটা পিছিয়ে। সঙ্গের হিসেবটিতে সে কথা স্পষ্ট। সড়ক ঘনত্ব বাড়লেও, সড়ক দৈর্ঘ্য কম হওয়ায় জাতীয় সড়কের উপর পণ্য পরিবহণের চাপ উত্তরোত্তর বাড়ছে এ রাজ্যে। এর পাশাপাশি ভৌগোলিক কারণে এ রাজ্যে সড়কের উপর ছুটে চলা ভারী যানবাহনের প্রায় অর্ধেক যাতায়াত করে উত্তর-পূর্ব ভারত সহ ভিন রাজ্যের শিল্প, কৃষি ও পরিষেবার প্রয়োজনে। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে রেল যোগাযোগের সীমাবদ্ধতার কারণেও এ রাজ্যের জাতীয় সড়কগুলির উপর পণ্য পরিবহণের চাপ বেড়ে চলেছে। ফলে এ রাজ্যের জাতীয় সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারকেই বিবেচনায় রাখতে হবে।
এই মুহূর্তে পণ্য পরিবহণের ৬০ শতাংশ আর যাত্রী পরিবহণের ৮৫ শতাংশ সড়ক যোগাযোগের উপর নির্ভরশীল। ফলে দেশ বা রাজ্যে ক্রমশ বেড়ে চলা নগরায়ণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে মানানসই সড়ক পরিকাঠামো গড়ে তোলা আজ নাগরিক পরিষেবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিল্পায়নের প্রয়োজনে রাজ্যের ৬১ শতাংশ রাস্তা, যা এখনও পিচের আবরণ-বঞ্চিত, সেগুলির দ্রুত মানোন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। পাশাপাশি পুরনো জাতীয় বা রাজ্য সড়কগুলি প্রযুক্তি-নির্ভর পথে সংস্কার করা উচিত। হাল আমলের ভারী পণ্যবাহী ট্রাক-ট্রেলার ইউনিটগুলির ভার বহনের উপযোগী করে তুলতে হচ্ছে পুরনো রাস্তাকে, যা সময় ও খরচসাপেক্ষ। বিশেষত দুই লেনের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়ক বন্ধ করে মেরামতির কাজ করা যায় না। আংশিক যান চলাচল চালু রেখে মেরামতির কাজ করার প্রযুক্তি ও প্রকরণ বহু ক্ষেত্রেই অমিল হওয়ায় মেরামতির গুণমান কাঙ্ক্ষিত মানের হয় না। এ রাজ্যের বেশির ভাগ রাস্তাই দাঁড়িয়ে রয়েছে নরম পলিমাটির ওপর। ফলে পোক্ত দীর্ঘস্থায়ী রাস্তা করার লক্ষ্যে ওই রকম পলিমাটির ভারবহন ক্ষমতা কৃত্রিম উপায়ে বাড়ানো নির্মাণের শুরুতেই করে নেওয়া উচিত। অন্যথায় এক বার রাস্তা তৈরি হয়ে গেলে তার নীচের দিকের মাটির মানোন্নয়ন খুবই কঠিন। গাড়ির সংখ্যা ও ভারের নিরিখে করা সাম্প্রতিক সমীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে এ রাজ্যের জাতীয় সড়ক ৩১এ, ৩৪, ৩৪এ ইত্যাদিগুলিকে অবিলম্বে প্রশস্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। এটি প্রয়োজন যান চলাচল সুরক্ষা ও পিচ রাস্তার স্থায়িত্বের প্রয়োজনেই। আন্তর্জাতিক অডিট সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশ যে, ভারতের রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কারণে বাত্‌সরিক জিডিপি বৃদ্ধি কমে যাচ্ছে ১.৫৫ শতাংশ। এই ক্ষতির পরিমাণ হল বছরে ১ কোটি বেকারের কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সমান।
কে কোথায়: চার রাজ্যে রাস্তার হাল
পশ্চিমবঙ্গ ২৫৭৮ .০৩২ ৩.৪ ৩৯
গুজরাত ৩২৪৫ .০৬৪ .৯ ৮৮
মহারাষ্ট্র ৪১৭৬ .০৪৩ ১.৪ ৮৫
তামিলনাড়ু ৪৮৩২ .০৭৭ ১.৭ ৭১
কলকাতা পুরনো শহর। এ শহরে রাস্তার পরিমাণ শহরের মোট এলাকার মাত্র ৬৫ শতাংশ, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। হাতে গোনা কিছু ফ্লাইওভার ছাড়া রাস্তা বাড়ানোর কোনও উপায় নেই। ফলে শহরের পরিবহণ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে বর্তমান রাস্তাগুলির মানোন্নয়ন ছাড়া দ্বিতীয় কোনও বিকল্প নেই। অথচ প্রতি বর্ষায় শহরের রাস্তাগুলি বেহাল হয়ে পড়ছে। বর্ষায় চুরমার হওয়া রাস্তায় ইটের তাপ্পি আর পুজোর আগে নতুন জামা গায়ে দেওয়ার মতো নতুন একটা পিচের চাদর। দেখতে দেখতে আমরাও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। শহরের অন্যতম জরুরি এই পরিষেবা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনও পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না। অথচ বছর বছর জলে ভাঙা রাস্তা সারাতে কোটি কোটি টাকা জলে যাচ্ছে।
রাস্তা মেরামতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হল রাস্তার রোগ নির্ণয়। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এখন অতি সহজেই ধরে ফেলা যায় রাস্তার বিভিন্ন স্তরের নির্মাণসামগ্রীর বর্তমান স্বাস্থ্যের হাল ও সেগুলির আয়ুর পূর্বাভাস। আর এই প্রযুক্তিনির্ভর পথেই সেই মেরামতি হওয়া উচিত, যা এ শহরে বিরল। অনেকেরই ধারণা, ভাঙা রাস্তার উপর নতুন পিচের চাদর দিলেই রাস্তা আবার শক্ত হয়ে ওঠে। চর্মরোগ চিকিত্‌সার বদলে রোগীকে নতুন জামা পরানোর মতোই হাস্যকর এই প্রচেষ্টাও। শহরে সিংহভাগ রাস্তা নষ্ট হওয়ার কারণ রাস্তার ওপর আর আশেপাশের এলাকায় জমা জলের অপ্রতুল নিকাশি ব্যবস্থা। এই বিষয়টির সুরাহা হলে শহরের রাস্তার আয়ু অনেকটাই বেড়ে যাবে।
রাস্তা মেরামতির কাজটা ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে করা উচিত। রাস্তার পুরনো অংশের সঙ্গে নতুন নির্মাণের সংযোগ যাতে পোক্ত হয়, তার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি মেরামতির পর্বে নিতে হবে। শহরের বাসস্টপগুলির আগে ও পরে ম্যাসটিক অ্যাসফল্ট-এর আস্তরণ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। তুলনামূলক ভাবে নিচু রাস্তাগুলিতেও এই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে শহরের ব্যস্ততম মূল রাস্তাগুলিকে কংক্রিটের আস্তরণে ঢেকে ফেলা দরকার। রাস্তার এই রূপান্তরের লক্ষ্যে রাস্তার নীচ দিয়ে যাওয়া ভূগর্ভস্থ পরিকাঠামোগুলি চিহ্নিত করে মূল রাস্তার বাইরে আনার পরিকল্পনা করা দরকার। কংক্রিটের রাস্তার প্রাথমিক খরচ খানিকটা বেশি হলেও এটির স্থায়িত্ব বেশি ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কম। এই লক্ষ্যে জে এন এন ইউ আর এম জাতীয় প্রকল্পের অংশ হিসেবে রাস্তা ও নিকাশি ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন প্রকল্প কেন্দ্রীয় সাহায্যের জন্য বিবেচিত হতে পারে। শহরের এক-তৃতীয়াংশ রাস্তা আগামী পাঁচ বছরে পর্যায়ক্রমে কংক্রিট দিয়ে গড়ে তুললে শহরে অনেকটাই গতির সঞ্চার হতে পারে।
সর্বোপরি শহরের রাস্তার সংস্কারের লক্ষ্যে একটি অভিন্ন সংস্থা তৈরি করা উচিত, যেটি পুরসভা-নগরোন্নয়ন-রেল-পূর্ত ইত্যাদি বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে রক্ষণাবেক্ষণের তদারকি করবে। রাস্তার ধারাবাহিক প্রযুক্তি-নির্ভর মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রতি পাঁচ বছরের মেয়াদে এই সংস্থা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। পরিশেষে শহরের মূল রাস্তাগুলি রক্ষণাবেক্ষণ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে সময়োচিত মেরামতি লালফিতের ফাঁসে আটকে না থাকে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.