ছুটির বাঁশি পশ্চিমবঙ্গের নীল গগনে বাজিয়া উঠিয়াছিল। সে বাঁশি প্রায় সকল বাঙালিই শুনিয়াছিলেন, বিচলিত হইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহারা কি টের পাইয়াছেন যে সে বাঁশি থামিয়াছে, ছুটির সুরে ছেদ পড়িয়াছে? কাজের বোল আবার দ্রিমদ্রিম বাজিতেছে? বোধ হয় না। কর্ণেন্দ্রিয়ের এই এক মহা দোষ, সে যাহা শুনিতে চায়, কেবল সেইটুকুই শুনে, বাকি সব কিছু তাহার কুহর গলিয়া মহাশূন্যে হারাইয়া যায়। বাঙালি তাই ছুটির ডাক দিব্য সজোরে শুনে, অথচ শেষবেলার ঘণ্টাটি বাজিবার সময় কেমন অন্যমনস্ক হইয়া থাকে। ফাঁকতালে ছুটিটি লম্বা হইতে লম্বাতর হইতে থাকে। শারদোত্সব সমাপ্ত, পার্বতী ফিরিয়া গিয়া সংসারের জমা-খরচে মন দিয়াছেন, কিন্তু বাঙালি তবুও উত্সব-ভাবে বিভোর। অফিসগুলি এখনও ফাঁকা, স্কুল-কলেজ তো বন্ধ বটেই, এমনকী হাসপাতাল ডাকঘর ব্যাঙ্কের মতো অত্যাবশ্যক পরিষেবাগুলিও ঝাঁপ খুলিতে অনিচ্ছুক। হ্যামলিনের বাঁশির মতো ছুটির সুর বাঙালিকে কিছুতেই ঘরে ফিরিতে দেয় না।
এই যে ছুটি-জাড্য, ইহা বাঙালির একান্ত আপনার বৈশিষ্ট্য। বিশ্বপৃথিবীর অন্য কোথাও যে চার-পাঁচ দিনের উত্সবে সাড়া পড়িয়া যায় না, এমন নহে। বহু দেশে, বহু সংস্কৃতিতে কখনও কখনও গোটা সপ্তাহ জুড়িয়াও ছুটির মুক্তির প্লাবন বহিতে দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো কুখ্যাত কর্মবীর দেশও বড়দিনের সময় সর্বব্যাপী তালা ঝুলাইয়া দেয়। নভেম্বরের ‘থ্যাঙ্কসগিভিং’ সপ্তাহান্তে সেখানে মুদির দোকান হইতে শুরু করিয়া হাসপাতালের চত্বরে মানুষের ছায়ামাত্র দেখা যায় না। কিন্তু সেখানে তাহা লইয়া গেল-গেল রব উঠে না, বরং শোনা যায়, আহা, মিস্টার মুদিরও তো ছুটি চাই, নতুবা সারা বত্সরের খাটনি তিনি খাটিবেন কী করিয়া! অপরের ছুটি বিষয়ে এমন সস্নেহ দর্শন কিংবা নিজের ছুটি বিষয়ে এই অপরাধবোধহীন প্রত্যয় উঠিয়া আসিতে পারে— ‘সারা বত্সরের খাটনি’র প্রতি সম্মান হইতে। কাজের নিয়মনিষ্ঠার প্রতি সম্মান হইতে। ওই সব সমাজে প্রতিটি মানুষই ছুটির পর যে যাহার কাজে যোগ দেয়, ছুটির পরের দিন কাজের সূচি ঘড়ির কাঁটার অব্যর্থতায় গড়াইতে শুরু করে। কাজে ‘ফিরিয়া আসিবার’ অভ্যাসটি রহিয়াছে বলিয়াই ছুটির আনন্দও সেখানে অপার হয়। নিজের আনন্দে অপরাধবোধের মিশেল থাকে না, অন্যের আনন্দের অধিকার বিষয়ে প্রশ্নহীন সহিষ্ণুতা থাকে। উল্টা দিকে, কাজে ‘ফিরিবার’ অভ্যাস যেখানে বা যাহাদের নাই, তাহাদের ক্ষেত্রে কাজ তো নষ্ট বটেই, ছুটিও নষ্ট। ব্যাটারি রি-চার্জ করিয়া কাজে না লাগাইলে চার্জ বাহির হইয়া যায়। আবার, সর্বক্ষণ চার্জের মধ্যে রাখিলে ব্যাটারি খারাপও হইয়া যায়।
চোদ্দোশো’ কুড়ির পশ্চিমবঙ্গ কি অন্য রকম ভাবিবে? কান পাতিলে শোনা যায়, এই বত্সর পশ্চিমবঙ্গের হাওয়ায় কিছু অন্য ডাক ভাসিতেছে, অল্প পরিমাণে হইলেও দু-চার জায়গা হইতে কাজের বোল উঠিতেছে, কাজ করিবার সুফল এবং না করিবার কুফল ফলিতেছে বলিয়া গুজব ছড়াইতেছে। ঘোষিত পরিবর্তনের কুহেলিকার আড়াই বত্সর পর সত্যই কিছু অঘোষিত পরিবর্তনের বাস্তবতা চোখে পড়িতেছে। ছুটি শেষ করিয়া কাজে ফিরিবার অমোঘ পরীক্ষা যদি এ বারও না দেওয়া যায়, আর কবে? মুখ্যমন্ত্রী সকলকে দেদার বিলাসে ছুটি দিয়াছিলেন, এ বার তিনিই আবার কঠোর সাহসে সকলকে ছুটি হইতে ডাকিয়া লউন। বাঙালিকে পরীক্ষায় বসাইয়া দিন। |