বিশ্বের মোট ক্ষুধার্ত মানুষের সিকি ভাগের ঠিকানা ভারত। সংবাদটি সহজে হজম হইবার নহে। দিনকয়েক পূর্বেই জানা গিয়াছিল, এই বত্সর ভারতে প্রায় আড়াই শত কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উত্পন্ন হইবে। এই বিপুল পরিমাণ খাদ্য সম্ভবত দেশের ২১ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের পাতে পৌঁছাইবে না। কেন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকিতে বাধ্য হন, সেই কারণের তালিকায় প্রথম নামটি রাজনৈতিক অস্থিরতার। সাধারণ অস্থিরতা নহে গৃহযুদ্ধ, অভ্যুত্থান ইত্যাদি। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা বাজারকে পঙ্গু করিয়া ফেলে, আর রাষ্ট্র তো অস্থিরতাতেই মগ্ন। বস্তুত, এই অস্থিরতার কারণেই আফ্রিকার বহু দেশে দীর্ঘ দিন ধরিয়া ক্ষুধা বিপদসীমার বহু ঊর্ধ্বে থাকিয়াছে। কিন্তু, ভারতে সামগ্রিক ভাবে সেই অস্থিরতা নাই। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রশাসন অচল, এমন অবস্থা স্থানবিশেষে কখনও ঘটিলেও দীর্ঘায়িত হয় নাই। তাহা হইলে ভারত এই অবস্থায় কেন? বস্তুত, যে সময়কালের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট ২০১৩ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচক (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স) তৈরি করিয়াছে, সেই ২০০৮ হইতে ২০১২ সালের অন্তত প্রথম তিনটি বত্সর ভারতীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্যও পড়শির ঈর্ষার কারণ হইবার মতো ছিল। ভারতের সমস্যা তবে কোথায়?
পরিসংখ্যান বলিতেছে, ক্ষুধার সূচকের তিনটি নির্ণায়ক— মোট জনসংখ্যায় প্রামাণ্য মানের তুলনায় কম ওজনের মানুষের অনুপাত, পাঁচ বত্সরের কম বয়ঃক্রমের শিশুদের মধ্যে কম ওজনের শিশুর অনুপাত, এবং শিশুমৃত্যুর হার— ২০০৩-০৭ এবং ২০০৮-১২ সালের মধ্যে তুলনা করিলে প্রতিটিতেই ভারত উন্নতি করিয়াছে। কিন্তু, সেই উন্নতির হার তাহার আর্থিক সমৃদ্ধির সহিত সঙ্গতি রাখিতে পারে নাই। ক্ষুধার তালিকায় ভারত দুনিয়ার ষোলতম স্থানে রহিয়াছে। এই তালিকায় ভারতের নিকটবর্তী দেশগুলি, মাথাপিছু জাতীয় আয়ের হিসাবে অদূর ভবিষ্যতেও ভারতের সমগোত্রীয় হইবে না। জ্যঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেনও এই বিচিত্র ঘটনাটির দিকে নির্দেশ করিয়াছিলেন। স্পষ্টতই, উপরতলার উন্নয়ন যথেষ্ট পরিমাণে চুঁয়াইয়া পড়ে নাই। বৃদ্ধি হইয়াছে, কিন্তু সর্বজনীন উন্নয়ন প্রকৃত প্রস্তাবে এখনও অধরাই থাকিয়া গিয়াছে। ব্যর্থতা এক দিকে রাজনৈতিক— এখনও উন্নয়নের পরিসরের বাহিরে পড়িয়া থাকা মানুষদের আওয়াজ ক্ষমতার অলিন্দে যথেষ্ট শোনা যায় না; অন্য দিকে প্রশাসনিক— যেটুকু উন্নয়ন পৌঁছাইয়া দেওয়া যাইত, তাহাও দুর্নীতি, অকুশলতা, পরিকাঠামোর অভাব ইত্যাদির ফলে আর হইয়া উঠে নাই। অধিকারভিত্তিক পুনর্বণ্টন, নাকি কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে যোগ দেওয়ার পথ খুলিয়া দেওয়া— উন্নয়ন কোন পথে আসিবে, নাকি দুইটি পথই জরুরি, এই তর্ক জারি থাকুক। লজ্জাটি না ভুলিলেই চলিবে।
তবে, ক্ষুধা অপুষ্টির একটি কারণ হইলেও একমাত্র নহে। অপুষ্টির দুইটি প্রধান উত্স দূষিত পানীয় জল এবং শৌচব্যবস্থার অভাব। এই দুইটি বিষয়ে পরিসংখ্যানও বলিবে, ভারতের আর্থিক সমৃদ্ধি উচ্চবিত্তের ভোগব্যয়ে যে প্রভাব ফেলিতে পারিয়াছে, সামান্য সুবিধাগুলির ক্ষেত্রে তাহা পারে নাই। অপুষ্টির আর একটি কারণ কৃমি। আফ্রিকার কিছু দেশে গবেষণা চালাইয়া দেখা গিয়াছে, যে স্কুলে ছাত্রদের নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়ানো হইয়াছে, সেই স্কুলে ছাত্ররা অনেক বেশি সুস্থ এবং পুষ্ট। ভারতে অপুষ্টি লইয়া যতটুকু ভাবা হয়, তাহা সচরাচর খাদ্যের বাহিরে পৌঁছাইতে পারে না। কৃমিনাশের ন্যায় অতি সামান্য ব্যয়ের একটি প্রকল্প কেন দেশব্যাপী চলিবে না? অপুষ্টির সহিত মোকাবিলায় এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজিবার সময় হইয়াছে। শুধু আয় বাড়িলেই উন্নয়ন হয় না। সেই আয়বৃদ্ধির সুফল মানুষের নিকট পৌঁছাইয়া দেওয়াও জরুরি। |