|
|
|
|
কাক, শুভাপ্রসন্ন আর গৌতম |
কেমন হল প্রতিবাদী চিত্রশিল্পীকে নিয়ে গৌতম ঘোষ-এর তথ্যচিত্র? লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী। |
বিষয় আর বিষয়ী কি কখনও একাকার হয়ে যায়? সৃজনপ্রক্রিয়ায় থাকে না দুইয়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবধান? গৌতম ঘোষের নতুন তথ্যচিত্র: ‘শুভা অ্যান্ড মি।’
|
গৌতম ঘোষ। |
নামটা জানার পর এমনই এক দার্শনিক জিজ্ঞাসা ভিতরে ভিতরে খোঁচাচ্ছিল। এ তা হলে শুধুই শুভাপ্রসন্নকে নিয়ে তথ্যচিত্র নয়। চিত্রশিল্পী ও ডকু-মেকারের যুগ্ম যাত্রা!
সিনেমা দেখে বোঝা গেল, নামটি ধার-করা। জার্মানিতে গুন্টার গ্রাস ও শুভাপ্রসন্ন একসঙ্গে ছবি আঁকছেন। ছবির নীচে ‘টিনড্রাম’-এর লেখক লিখে দিলেন, ‘শুভা অ্যান্ড মি।’ গৌতম ঘোষ সেই নামটিই ধার করেছেন। ইংরেজি সর্বনামের আড়ালে গুন্টার গ্রাস থেকে গৌতম ঘোষ কত বিষয়ই যে লুকিয়ে থাকল!
তথ্যচিত্রের সব চেয়ে উল্লেখ্য দৃশ্য: গঙ্গার ধারে একটি কুকুরের ভিজে ঢোল হয়ে-যাওয়া মৃতদেহ। একটি কাক সেই মরা কুকুরের চোখ খুবলে খাচ্ছে। ‘হাইড্রান্ট খুলে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল’ গোছের জীবনানন্দীয় চেতনার কথা মনে পড়তে পারে। শুভাপ্রসন্নর অন্যতম দিগ্দর্শন ছিল এই সব কাকেরা। “কাক আমার কাছে কলকাতার প্রতীক। কাকের কালোর মধ্যে আমি অনেক রং দেখতে পাই,” তথ্যচিত্রে চারকোলে ছবি আঁকতে আঁকতে বলছেন শুভাপ্রসন্ন। এই শিল্পীর আঁকা কাকের মধ্যে ধূসর, হাল্কা নীল কত রং-ই
যে ফুটে ওঠে, বঙ্গসংস্কৃতি জানে। কাকের প্রসঙ্গে এখানে এসেছে
ব্রিটিশ কবি টেড হিউজের কথাও।
‘হি স্টাফ্ড ইনটু মেন দ্য টেল হাফ
উইথ দ্য উডেন এন্ড হ্যাঙ্গিং আউট’...
কাকচরিত্র নিয়ে এ রকম কত কথাই যে ছিল
তাঁর কবিতায়। শুভাপ্রসন্ন তাঁর কাকের ছবির কথা টেড হিউজকে জানিয়েছিলেন, টেড কলকাতায় আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। টেড হিউজ অবশ্য
স্ত্রী সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যুর পর
কাকের কবিতাগুলি লিখেছিলেন। ফলে ‘স্টাফ্ড ইনটু মেন দ্য টেল হাফ’-এর মতো যৌনতার আবছা অনুষঙ্গ ছিল। শুভাপ্রসন্নর দুই কাকের মধ্যেও কি রয়ে যায় সেই ইঙ্গিত? তথ্যচিত্র এই প্রসঙ্গে নীরব।
তথ্যচিত্র সরব অন্য প্রসঙ্গে। শুভাপ্রসন্নর ছবি আঁকার দৃশ্যগুলির মধ্যে মাঝে মাঝেই আছড়ে পড়েছে ‘কালবেলা’ থেকে ‘পার’, ‘মনের মানুষ’, ‘আবার অরণ্যে’র ফুটেজ। কেন কে জানে! চিত্রশিল্পী আর ফিল্মমেকারের যুগ্ম যাত্রা দুনিয়ায় বিরল নয়। সালভাদর দালি-লুই বুনুয়েল, অ্যান্ডি ওয়ারহল-জ্যাক স্মিথ অনেক কথাই মনে পড়তে পারে। কিন্তু এই ভাবে একই প্রজন্মকে ধরা যায়? ১৯৪৭ সালে জন্মানো শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য এই শহরের অন্যতম ‘মিডনাইট্স চিলড্রেন’, সেটাও বলা
হল না। |
গুন্টার গ্রাস ও শুভাপ্রসন্ন। |
শুধু টাব্বু ডুয়ার্সের অরণ্যে‘ও যিশু আই অ্যাম ড্রাঙ্ক’ বলে হেসে উঠলেন কিংবা সাদা দাড়িতে প্রসেনজিৎ গেয়ে উঠলেন ‘মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে।’ পরিচালকের নিজের কথাই এই তথ্যচিত্রকে ডুবিয়েছে। গুন্টার গ্রাসের সামনে শুভাপ্রসন্নকে বসিয়ে দিয়েও উঠবে না গ্রাসের ‘ফ্লাউন্ডার্স’ উপন্যাসের অনুষঙ্গ? চল্লিশ বছর আগের সেই উপন্যাসেও ছিল কলকাতার কথা।
গ্রাস যখন ছোটবেলায় তাঁর নাৎসিপ্রেমের কথা বলে সারা পৃথিবীতে ধিক্কৃত, শুভাপ্রসন্নই কড়া ভাষায়
তার প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই সব কিছুই এল না। মি মানে শুধু গ্রাস নয়। গৌতম ঘোষও!
আর সেখানেই এই ছবির দুর্বলতা। শুভাপ্রসন্নের ‘অন্য নাগরিক’ বইতে চমৎকার ভঙ্গিতে ধরা পড়েছিল গুন্টার গ্রাসের বাড়ি, রোজকার জীবন। সেই বইয়ের উল্লেখ হল না। বরং ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’ গুন্টার গ্রাসকে ইন্টারভিউ করতে গিয়ে নিও লিবেরাল অর্থনীতির বিরুদ্ধে কথা! খুব ভাল। কিন্তু ‘যাত্রা’, ‘আবার অরণ্যে’ থেকে ‘শূন্য অঙ্ক’...একই বিপ্লবী সংলাপ আর কত পুনরাবৃত্তি করবেন গৌতম? যে পরিচালক ‘বিসমিল্লা’র তথ্যচিত্রে বারাণসীর আকাশে কাকেদের চমৎকার ওড়াউড়ি কিংবা সিল্ক রুটে তাকলামাকান মরুভূমির সূর্যাস্ত দেখিয়েছিলেন, ‘মোহর’ তথ্যচিত্রে শান্তিনিকেতনের আদিগন্ত মাঠের প্রেক্ষিতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া সুর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, জ্যোতি বসুকে নিয়ে তথ্যচিত্রে পদ্মার স্রোতের পাশাপাশি লাল-পতাকার ঢেউও এনেছিলেন, তাঁর কাছ থেকে এই দুর্বলতা কি আদৌ প্রত্যাশিত ছিল?
|
|
|
|
|
|