|
|
|
|
ন্যাকামিটা আমার রক্তে |
তবু তিনি মানেই ‘সুরভিত’ নস্টালজিয়া। এত দিন পরেও তরুণ যুবকেরা ছুটে আসে তাঁর
সই নিতে।
আর তিনি? শ্রাবন্তী মজুমদার-এর সঙ্গে আড্ডায় স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়। |
শ্রাবন্তী মজুমদার মানেই এক ধরনের উত্তেজনা। নেশা। আর হাস্কি টোনের সম্মোহন। নিজের এই ইমেজটাকে কেমন করে তৈরি করলেন?
এই ঝোঁকটা সহজাত। জানি প্রচুর মেয়ে আমার মতো গলা তৈরি করার জন্যে সিগারেট খায়। কিন্তু এ ভাবে কি কিছু হয়? আসলে প্রথম থেকেই আমার গলা, ভাবনাচিন্তা সে সময়ের চেয়ে আলাদা ছিল। কোনও দিন লতাজি-আশাজির মতো করে গান গাইতে চাইনি। বাঙালি মহিলা হিসেবে আমিই প্রথম স্টেজে শাড়ি পরে ওয়েস্টার্ন অ্যারেঞ্জমেন্টে বাংলা গান গেয়েছি।
লোকে যখন আপনাকে ‘ন্যাকা শ্রাবন্তী’ বলে, কেমন লাগে?
ন্যাকামিটাও আমার রক্তে। তবে ন্যাকামি করব বলে কিন্তু করিনি। আসলে এগুলো কোনওটাই ততটা জরুরি নয়। আন্তরিক কথনই রেডিয়োর মাস্টার স্ট্রোক। আর কিছু লাগে না।
কেবল তো কণ্ঠ নয়, সম্পর্ক, প্রেম সব কিছুতেই আপনি ব্যতিক্রমী...
আমি রোম্যান্টিক। প্রেমই আমার জীবনের প্রথম শর্ত। আমি ভালবাসতে ভালবাসি, আর এই ভালবাসাই আমার কাজে শক্তি হয়ে ফিরে আসে। নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে শেখায়। আমি বরাবর আমার বাবাকে বলতাম, কেবলমাত্র একজনকে ভালবেসে বিয়ে করে সারা জীবন কাটানো যায় নাকি? বিয়ের পর যদি আবার আমার কাউকে ভাল লাগে? কী করব তখন?
গানের ক্ষেত্রে আপনি আপনার মেন্টরের কথা খুব বলেন? প্রেমের গান গাইতে গিয়ে কি আপনি শুধু ওঁর কথাই ভাবেন?
জীবনের প্রথম দিকেই আমি আমার মেন্টরকে পেয়েছিলাম। উনি আর্মির মানুষ ছিলেন। বয়সে, অভিজ্ঞতায় অনেক এগিয়ে। ট্যালেন্ট চিনতেন। আমি তো গান গাইতেই এসেছিলাম। কিন্তু ওঁর উৎসাহেই আমার কথা বলা শুরু। উনি মহীরুহের মতো আমার জীবন জুড়ে ছিলেন। নিজের জন্যে আলাদা করে আমায় তখন কিছুই ভাবতে হয়নি। ওঁকে খুবই মিস করি। |
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। |
আপনি কি ওঁর সঙ্গে লিভ-ইন করতেন?
না, এটা ভুল কথা।
ওঁর নামটা..
নাম নিয়ে কী করবেন? উনি তো নেই।
উনি নেই বলেই কি আপনি অবশেষে বিয়ে করলেন?
নাহ্। আমার সব কাজের মধ্যে উনি আজও আছেন। তার সঙ্গে বিয়ের কোনও যোগ নেই। আমি আমার বিদেশি স্বামীকে ভালবেসেই বিয়ে করেছি।
আপনার ভিনদেশি স্বামী আপনার
গান শোনেন?
হ্যা।ঁ শোনে। কথা না বুঝলেও সুর বোঝে। আমাকে খুব প্যাম্পার করে।
আপনি কি আজও প্রেমে পড়েন?
নিশ্চয়ই, আর সেটা আমার বর্তমান স্বামীর সঙ্গে শেয়ার-ও করতে পারি।
তবে কি ভালবাসার টানেই দুম করে সব ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন?
নাহ্, তা কিন্তু নয়। ভেবেছিলাম পঁচিশ বছর কাজ করার পর একটু থামি, দেখি না মানুষ আমায় মনে রাখে কি না। কিন্তু দেখলাম আমাদের দেশের মানুষ বিদেশিদের মতো নয়। এখানে আউট অব সাইট হলেই সব ফুরিয়ে যায়। তাই গান নিয়ে ফিরলাম।
ফিরতে গিয়েও সেই নস্টালজিয়ার হাত ধরেই ফিরতে হল কেন?
নতুন করে ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। ভাবছিলাম কেমন করে নানা ধারার গান একটা অ্যালবামে নিয়ে আসব? আমার এক কাছের সাংবাদিক বন্ধু আমায় বললেন আমি মানেই বাঙালি নস্টালজিয়া। সেই কথা মাথায় রেখেই বিসর্জনের গান থেকে আমার শ্বশুরবাড়িকে ঘিরে গান নিয়ে ‘নস্টালজিয়া’ অ্যালবামটা করে ফেললাম।
আপনি তো বরাবর নিজেই কথা বলে গান গেয়েছেন, এই নতুন অ্যালবামে শোনা গেল এক দৃপ্ত পুরুষ কণ্ঠও। আপনাকে আজ হঠাৎ অন্য কণ্ঠের সাহায্য নিতে হল কেন?
আমি যে বাঙালির নস্টালজিয়া, সেটা আমি আজও বুঝতে পারিনি। তাই চেয়েছিলাম অন্য কেউ এ নিয়ে আমায় কিছু জিজ্ঞেস করুন। সেই কথার সূত্র ধরেই আমি গানের মালা গাঁথব। এটা একটা এক্সটেম্পো-র মতো হয়েছে। কথা আর গানের মাদকতায় ফিরে এসেছে ফেলে আসা সময়ের শব্দ-ছন্দ।
অ্যালবামের খানিকটা শুনতে গিয়ে মনে হল পুলক বন্দ্যোপাধায় থেকে শৌভিক মিশ্র, সব ধারার গান এই অ্যালবামে আছে...
একদমই তাই। এই অ্যালবামটা যেহেতু ডিজিট্যালি লঞ্চ হবে, তাই মুড অনুযায়ী গান শুনতে পাবেন শ্রোতারা।
আমার মনে হয় আপনার এমন মোহময় কণ্ঠ বড় বেশি বিজ্ঞাপনের কণ্ঠ হয়ে মানুষের কাছে থেকে গিয়েছে। এই অ্যালবাম কি সেই ঘাটতি পূরণ করে সঙ্গীতশিল্পী শ্রাবন্তীকে উজ্জ্বল করবে?
আগে অনেকে বলতেন আমায় একক অ্যালবাম করার কথা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তো কেবলই বলতেন, “এত কথা বলিস না। গানের গলা খারাপ হয়ে যাবে।” কিন্তু তখন মনে হয়নি যে কেবল গানই গাইব। ‘ভূমি’র সুরজিৎ একবার বলেছিল, “শ্রাবন্তীদি তুমি একক করো, তুমি তোমার চাহিদা জানই না।” এই অ্যালবাম সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আমাকে উজ্জ্বল করবে কি না জানি না। কিন্তু চেষ্টা তো থেকেই যায়।
আর কী ধরনের গান গাওয়ার ইচ্ছে? শ্যামাসঙ্গীত-রবীন্দ্রসঙ্গীত। কিন্তু কোনও বিকৃতি না করে। বিকৃতি মানে?
মানে কথা, সুর বদলে, না জেনে যন্ত্রের ব্যবহার করে কখনওই গাইব না।
আর পোশাক?
রবীন্দ্রনাথের গান বা শ্যামাসঙ্গীত জিন্স পরে গাইলে আমার একটু অস্বস্তি হয়।
ফিরে আসার নস্টালজিয়া কি আজকের প্রজন্মকে টানবে বলে আপনার মনে হয়? কারণ জেন ওয়াই তো তেমন করে আপনাকে শোনেনি...
জানো আমার এক ভক্ত আছে, যার বয়স সতেরো। সে তার মায়ের কাছ থেকে আমার সমস্ত গান শুনেছে। আমার গানের সব কথাই ওর মুখস্থ। অ্যাকাডেমি চত্বরে গেলে আজও অনেক তরুণ যুবক আমার সই নিতে ছুটে আসে। আমি থমকে যাই।
অগুনতি প্রেমিক-ভক্তদের শ্রাবন্তী মজুমদার কেমন করে সামলান?
দ্যাখো আমি আহামরি কিছু দেখতে নই। তাই অনেক প্রেমিক থাকবে এমনটাও নয়।
কী বলছেন? আপনার জন্যে কত পুরুষের সংসার হল না...
(কথা থামিয়ে) না না, আমি সেক্সি হতে পারি কিন্তু কোনও ভারতীয় পুরুষ এসে আমায় প্রেম নিবেদন করবে এটা কখনও ভাবিনি। আমাকে সবাই খুব ভয় পেত।
শুধু গান গাইলে বিজ্ঞাপনের সংসারের কী হবে? আমরা কি শ্রাবন্তীর রেডিয়ো নাটকে নিজেদের রবিবারগুলোকে জড়িয়ে রাখতে পারব না আর?
না, সে রকম হয়তো আর হবে না। আমার সময়টার কথা ভাবো একবার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার রেডিয়ো নাটকের জন্যে নাটক লিখতেন। মিহির সেনকে একটা লেখা আমি দশ বার লিখিয়েছিলাম। বিকাশ রায় বলতেন এই ছোট মেয়েটার আমায় বকতে পারার কনফিডেন্সই আমাকে ওর নাটকে আটকে রাখে। এখন এ রকম ট্যালেন্টেড মানুষ পাব?
উত্তমকুমারকে নিয়ে কখনও নাটক করতে ইচ্ছে হয়নি?
কেন হবে না? কত বার বলেছি উত্তমদাকে। উত্তমদা রেডিয়ো নাটক করতে চাননি। বলেছিলেন আর যাই করো, আমায় মাইকের সামনে অভিনয় করতে বোলো না। তবে দীপঙ্কর দে এসেছিলেন আমার কাছে। ওঁকে দিয়ে জোর করে আমি কিরীটী রায় করাই। আজও শ্রীকান্ত আচার্য সেই নাটকের কথা বলেন আমায়।
এখনকার বাংলা ছবি দেখেন?
(বিস্মিত চোখে দু’হাতে মুখ ঢাকলেন)।
আর বাংলা বা হিন্দি গান?
প্রচুর গান শুনি। নচিকেতার গান শুনলে ওকে আলাদা করে বোঝা যায়। গানের ক্ষেত্রে স্বকীয়তাটা জরুরি। লোপামুদ্রা, শুভমিতা, শ্রীকান্ত, এদের গানও ভাল লাগে।
জীবনের শেষ মুহূর্ত কলকাতা না আইল অব ম্যান, কোথায় কাটাতে চাইবেন?
অবশ্যই আইল অব ম্যান-এ। যেখানে এখন থাকি। কারণ ওখানে আমার পুরনো কলকাতাকে পাই। বদলের কলকাতায় ফিরতে চাই না আমি।
|
|
|
|
|
|