কাস্তে-হাতুড়ি হার মেনেছে। এ বার চ্যালেঞ্জ জোড়া খুকরি।
গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার শক্ত ঘাঁটি দার্জিলিং পাহাড়। জোড়া খুকরি-শোভিত পতাকার দল মোর্চা গত বছর জিটিএ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছিল। এ বার মোর্চার নাকের ডগায়, খোদ দার্জিলিং জেলা সদরে, পাহাড় তৃণমূলের প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন হতে চলেছে। আগামী ২৪ অক্টোবর ওই সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের কর্মিসভা ও সমাবেশে যোগ দিতে পাহাড়ে আসছেন তিনি।
এ মাসেরই গোড়ার দিকে কার্শিয়াঙে তৃণমূল শীর্ষ নেতা মুকুল রায়ের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন সরকারি দফতরে কর্মরত স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মীদের একটি বড় অংশ। তাঁরা সকলেই আগে মোর্চার সমর্থক ছিলেন। এখন তৃণমূলের অন্দরের খবর, জিটিএ সদস্য-সহ মোর্চার কিছু বড় নেতা ২৪ অক্টোবর তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন। গ্রেফতার হয়ে যাঁরা জেলে রয়েছেন, মোর্চার সেই নেতা-কর্মীদের পরিবারের লোকেরাও তৃণমূলের দিকে ঝুঁকছেন এ কথা একান্তে স্বীকার করছেন মোর্চা নেতারাই। ফলে পাহাড়ে তৃণমূলের এই রাজনৈতিক সমাবেশ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন তাঁরা।
কেন পাহাড়ে রাজনৈতিক জমি শক্ত করছে তৃণমূল? দলের নেতারা জানাচ্ছেন, আলাদা রাজ্যের দাবিতে টানা বন্ধের মোকাবিলায় এত দিন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছেন মমতা। কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশ মোতায়েন, মোর্চা নেতাদের ব্যাপক হারে গ্রেফতার, সমর্থক এবং অর্থের জোগানদারদের পাকড়াও, প্রশাসন তথা পরিবহণ সচল রাখা এ সবই করা হয়েছে। তবু জনজীবন স্বাভাবিক রাখা যায়নি। তাই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রস্তুতি। তাঁদের বক্তব্য, সে কারণে পাহাড়ে পঞ্চায়েত ভোটের লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে তৃণমূল। লোকসভা ভোটের আগেই এই পঞ্চায়েত ভোট করার পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্যের। |
পাহাড়ের পঞ্চায়েতগুলির একাংশ তৃণমূল
পেলে স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে মোর্চার বন্ধ কর্মসূচির মোকাবিলা করা যাবে বলেই তৃণমূলের ধারণা। আর সে জন্য তৃণমূল নেত্রীর পাহাড় সফর গুরুত্বপূর্ণ বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা।
মুকুলবাবু জানান, মুখ্যমন্ত্রী
পাহাড়ে যাবেন অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে। সেখানে একাধিক সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তিনি। সেই সময়, ২৪ অক্টোবর পাহাড় তৃণমূলের প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন। সেই অনুষ্ঠানে তৃণমূল নেত্রীকে হাজির থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। মমতা তাতে সম্মতি দিয়েছেন। “সম্মেলন ও দলের কর্মী-সমাবেশ একই জায়গায় হবে কি না, সেটা শীঘ্রই ঠিক হবে,” বলেন মুকুলবাবু।
তৃণমূলের এই কর্মসূচি কার্যত রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতাদের। তাই ঘর সামলানোর কৌশল খুঁজতে আসরে নেমে পড়েছেন তাঁরা। সে জন্য তাঁরা তৃণমূল স্তরে জনসংযোগ বাড়ানোর কথা ভাবছেন। মোর্চা সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই দলের সব শাখা স্তরের নেতাদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে প্রতিটি বুথ কমিটিতে ঘরোয়া বৈঠকের
নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই সব বৈঠকেও এলাকার কর্মী-সমর্থকদের ভিড় আগের মতো হচ্ছে না বলে মানছেন নেতারা। উপরন্তু, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাহাড়ে
মোর্চার যে ২২০০ জন নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের অনেকে প্রকাশ্যে মোর্চা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ওই সব পরিবারের একাংশ তৃণমূলে সামিল হওয়ার দিকে ঝুঁকছেন বলেও মোর্চা নেতারা স্বীকার করছেন। যদিও কালিম্পঙের বিধায়ক তথা মোর্চার প্রচার সচিব হরকাবাহাদুর ছেত্রীর মতো কেউ কেউ বলছেন, এ ভাবেই চাপ দিয়ে তাঁদের ঘর ভাঙতে
চাইছে তৃণমূল। |
মোর্চা কেন কোণঠাসা |
• যথেচ্ছ বন্ধের জেরে পুজোর মরসুমে পর্যটক নেই।
• হোটেলকর্মী, গাড়িচালক, গাইডদের আয় তলানিতে।
• পুরো মাইনে না পেয়ে ক্ষুব্ধ সরকারি কর্মীদের একাংশ।
• বহু ব্যবসায়ী গ্রেফতার, তাই বাকিরা চাঁদা দিতে নারাজ।
• ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে।
• উন্নয়ন পর্ষদ পেয়ে লেপচারা জনজীবন স্তব্ধ করতে নারাজ। |
|
তা হলে কি ঘর ভাঙার ভয় পাচ্ছে মোর্চা? তার সম্ভাবনা যে আছে, সেটা মোর্চা নেতৃত্বের কথাতেই স্পষ্ট। হরকাবাহাদুর বলেন, “ওই সভায় পাহাড়বাসীর একাংশ তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন। তাতে মোর্চার কোনও ক্ষতি হবে না।” তাঁর দাবি, “আলাদা রাজ্যের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের জন্য অধিকাংশ পাহাড়বাসী কিন্তু মোর্চার সঙ্গেই থাকবেন।”
তৃণমূল মনে করছে, বন্ধ মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক দৃঢ়তা ও কড়া মনোভাব থেকেই পাহাড়ের মানুষের বড় অংশের প্রশংসা পাচ্ছে সরকার। আর তৃণমূল পাচ্ছে সমর্থন। সঙ্গে যোগ হয়েছে মোর্চার কাজ না করে আন্দোলনে জোর দেওয়া। জিটিএ-র ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে থাকলেও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গড়ার ব্যাপারে মোর্চা এগোয়নি। উল্টে, পথে নেমে জনজীবন স্তব্ধ করেছে।
পাহাড়ের প্রায় ছয় হাজার অস্থায়ী সরকারি কর্মীকে স্থায়ীকরণের আশ্বাস দিয়ে অন্য একটি চালও দিয়েছে রাজ্য। তাঁরা শাসকদলের দিকে ঝুঁকেছেন। তা ছাড়া, লেপচাদের মতো উন্নয়ন পর্ষদ পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে তামাঙ্গ সম্প্রদায়ও। ফলে চিড় ধরছে মোর্চার সমর্থকদের মধ্যে। মোর্চা ছাড়া গোর্খাল্যান্ডের সমর্থক অন্য যে দলগুলি রয়েছে, তাদের উপরেও তেমন ভরসা নেই তিতিবিরক্ত জনতার। তৃণমূল নেতারা মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে পাহাড়ে মোর্চার বিকল্প হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়।
এই পরিস্থিতিতে তাই মমতার সভার দিকেই নজর দু’পক্ষের। |