একের পর এক পুরসভায় দলের চেয়ারম্যান এবং কাউন্সিলরেরা নাম লেখাচ্ছেন তৃণমূলে। কেন এমন দলত্যাগের হিড়িক, তা নিয়েও অনর্থ বেধেছে কংগ্রেসে!
শাসক দলের বিরুদ্ধে ভয় এবং প্রলোভন দেখিয়ে দল ভাঙানোর অভিযোগ তো আছেই। পাশাপাশিই, প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব দলত্যাগীদের ‘ক্ষমতালোভী’ বলে অভিহিত করছেন। তৃণমূলে যোগদানকারীরা আবার পাল্টা বলছেন, দলীয় নেতৃত্বের উদাসীনতা ও আন্দোলন-বিমুখতায় বিরক্ত হয়েই তাঁরা কংগ্রেস ছেড়েছেন। এমতাবস্থায় দলের ভাঙন রোধে হাইকম্যান্ডেরই দ্বারস্থ হচ্ছেন প্রদেশ নেতৃত্ব।
কৃষ্ণনগরের অসীম সাহা, বীরনগরের পার্থকুমার চট্টোপাধ্যায়, কোচবিহারের বীরেন কুণ্ডু, দুবরাজপুরের পীযূষ পাণ্ডে বিভিন্ন এলাকায় দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া পুরসভার চেয়ারম্যানদের ক্ষোভ, তাঁদের সমস্যা নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মাথাব্যথা ছিল না! সংগঠন ধরে রাখতে জেলা বা প্রদেশ স্তরে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি নেওয়া হয় না। তাঁদের সোজাসাপটা বক্তব্য, কংগ্রেস নেতৃত্বের উদাসীনতা রাজ্যে দলের ভবিষ্যতকে ক্রমশ অনিশ্চিত করে তুলছে।
বস্তুত, সাম্প্রতিক কালে দলত্যাগের হিড়িকে নাজেহাল অবস্থা প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের! গত সেপ্টেম্বরে ১২টি পুরসভার ভোটের ঠিক আগে বীরভূমের দুবরাজপুর পুরসভার চেয়ারম্যান পীযূষবাবু যে ভাবে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন, একই ভাবে মঙ্গলবার নদিয়ার কৃষ্ণনগর পুরসভার চেয়ারম্যান অসীম সাহা তাঁর ১৪ জন কাউন্সিলরকে নিয়ে কংগ্রেস ছেড়েছেন। গত সেপ্টেম্বরে নদিয়ারই বীরনগর পুরসভার চেয়ারম্যান পার্থবাবু তাঁর ৮ কাউন্সিলরকে নিয়ে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। দুই মেদিনীপুরের ঘাটাল ও এগরা পুরসভাতেও একই হাল কংগ্রেসের। রাজ্যে ১২৭টি পুরসভার মধ্যে এখন ১০৮টিতেই তৃণমূল ক্ষমতায়। বামেরা ১৬টিতে এবং কংগ্রেস মাত্র ৪টি পুরসভা চালাচ্ছে।
সাংগঠনিক ভাবে এমন কোণঠাসা অবস্থায় তাঁদের করণীয় ঠিক করতে দিল্লির পরামর্শ চাইছেন প্রদেশ নেতৃত্ব। অসীমবাবুদের একযোগে দলত্যাগের ঘটনা জানিয়ে এআইসিসি-র সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী ও পশ্চিমবঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক সি পি জোশীকে আজ, বৃহস্পতিবার চিঠি পাঠাচ্ছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। তৃণমূল নেতৃত্ব প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে কংগ্রেসে ভাঙন ধরাচ্ছেন বলে প্রদীপবাবুর অভিযোগ। তাঁর কথায়, “সিপিএমকে সরিয়ে আমরা স্বৈরতন্ত্র চাইনি। কিন্তু এখন স্বৈরতন্ত্র চলছে! রাজ্যে যে গণতন্ত্রকে হত্যা করার যড়যন্ত্র চলছে, তা দিল্লির নেতৃত্বকে জানাচ্ছি।” এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস কী ভাবে লড়াই করবে এবং সে ক্ষেত্রে দিল্লি কতটা সাহায্য করবে, তা-ও রাহুলদের কাছে জানতে চান প্রদীপবাবু।
প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানস ভুঁইয়ার মতো নেতারা অবশ্য মনে করেন, এই সংকট থেকে দলকে চাঙ্গা করতে দলকে আন্দোলনমুখী করা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। মানসবাবুর বক্তব্য, “এক জন কংগ্রেস কর্মী হিসাবে আমি মনে করি, দলে একটা গতিশীল অবস্থা তৈরি করা দরকার। বর্তমান শাসকদের সম্পর্কে মানুষের ক্ষোভ, কংগ্রেস কর্মীদের উপরে যে অত্যাচার রাজ্য জুড়ে চলছে, তা নিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ গণ-আন্দোলন করা না গেলে এই ধরনের যাতায়াত বেড়ে যাবে!”
মানসবাবুর বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটাই একমত পার্থবাবু, অসীমবাবু-সহ দলত্যাগী কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই। বীরনগরের পার্থবাবুর অভিযোগ, “মফস্সল বা জেলায় দল করতে গেলে আমাদের যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তা দূর করতে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের যে সহযোগিতা দরকার, তা আমরা পাইনি। এমনকী, সংগঠন ধরে রাখতে যে রাজনৈতিক কর্মসূচি নেওয়া দরকার, জেলা বা প্রদেশ থেকে তা নেওয়া হয়নি। উল্টে সংগঠন করতে গিয়ে আমরা জেরবার হয়েছি জেলা নেতৃত্বের দুই গোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দ্বে!” কৃষ্ণনগরের অসীমবাবুরও বক্তব্য, “সামনে ভোট। দলের কাউন্সিলরদের তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রশাসনিক চাপ ও সন্ত্রাস যখন তুঙ্গে, আমি প্রদীপদাকে কৃষ্ণনগরে এসে সভা করার জন্য আর্জি জানিয়েছিলাম। কিন্তু উনি তো এলেনই না! উল্টে আমাকে বলা হল, দল ছাড়ার বাহানা হিসাবে আমি সন্ত্রাসে আক্রান্ত বলে নাটক করছি!” তাঁর আরও ক্ষোভ, “প্রদীপদা বা প্রদেশ নেতৃত্ব পাশে থাকলে আমাদের কংগ্রেস ছাড়তে হত না। এ বারও কৃষ্ণনগরে ২৪টা ওয়ার্ডের মধ্যে ১৯-২০টাতে কংগ্রেসের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল।”
অসীমবাবুদের বক্তব্যের সঙ্গে প্রত্যাশিত ভাবেই একমত নন প্রদীপবাবু থেকে শুরু করে প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তীর মতো পদাধিকারীরা। অমিতাভের পাল্টা মন্তব্য, “যাঁদের ক্ষমতার লোভ আছে, তাঁরাই আত্মসমর্পণ করবেন! যাঁদের লোভ নেই, তাঁরা লড়াই করবেন।” |