মঙ্গলবার ছিল জল ছাড়া নিয়ে তরজা। রাজ্যকে না জানিয়ে একাধিক জলাধার থেকে জল ছাড়ার অভিযোগ করে ডিভিসি এবং ঝাড়খণ্ডকে দুষেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী, এ নিয়ে নালিশ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে চিঠিও দিয়েছিলেন তিনি। বুধবার সকাল থেকেই জল ছাড়ার পরিমাণ কমিয়েছে ডিভিসি এবং ঝাড়খণ্ড। এবং সে জন্য মুখ্যমন্ত্রীকেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন রাজ্য প্রশাসন। সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠানোর পরেই ঝাড়খণ্ড ও ডিভিসি জল ছাড়ার পরিমাণ কমিয়েছে।” ঝাড়খণ্ডের জলসম্পদ বিভাগের সচিব (পরিকল্পনা) অবিনাশ কুমার ও ডিভিসি-র একাধিক অফিসার অবশ্য বলছেন, কৃতিত্ব যদি কারওকে দিতে হয় তা প্রাপ্য প্রকৃতির। বৃষ্টি কমেছে। তাই জল ছাড়ার পরিমাণও কমেছে। একই সঙ্গে, জল ছাড়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের দিকে আঙুল তোলায় ক্ষোভ জানিয়েছে ঝাড়খণ্ড প্রশাসন।
ঝাড়খণ্ডের জলসম্পদ বিভাগের সচিব এ দিন এ রাজ্যের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনতেও ছাড়েননি। তিনি বলেন, “জল ছাড়া নিয়ে যদি আমাদের বিরুদ্ধে এতই অভিযোগ থাকে, তা হলে কেন ওরা (পশ্চিমবঙ্গ) সে কথা লিখিত ভাবে জানাচ্ছে না? আমরা তো বার বার বলছি, পশ্চিমবঙ্গের সেচসচিবের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” অবিনাশ কুমারের বক্তব্য, সংবাদমাধ্যম দুই রাজ্যের কথা বলার মাধ্যম হতে পারে না। উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকার পরেও কেন এই কথা উঠছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। ঝাড়খণ্ডের জলসম্পদ দফতরও এ দিন জানায়, সেখানকার খড়কাই ও সুবর্ণরেখা নদীর জল এখন বিপদসীমার নীচে দিয়ে বইছে। সুবর্ণরেখার বিপদসীমা যেখানে ১২১ মিটার, এ দিন সেখানে জল বইছে ১১৯ মিটার উঁচু দিয়ে। একই ভাবে খড়কাইয়ের বিপদসীমা ১২৯ মিটার, জলতল রয়েছে ১২৮ মিটারে।
কলকাতার আবহাওয়া দফতরও জানিয়েছে, এ মাসের প্রথম ১৫ দিনে ঝাড়খণ্ডে অতিবৃষ্টি হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি। এর ফলে ছোটখাটো সব নদনদী, খালবিল তো বটেই, বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায় চলে গিয়েছে। আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের বর্ষার বেশির ভাগ সময়েই ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টির ঘাটতি ছিল। কিন্তু অক্টোবরের গোড়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠা মৌসুমি অক্ষরেখার দাপটে বৃষ্টি বাড়ে। ঘূর্ণিঝড় পিলিন-এর জেরে তা আরও বেড়ে যায়। আবহবিদেরা জানান, আচমকা অতিবৃষ্টির কারণেই ঝাড়খণ্ডে বিভিন্ন জলাধারে জলস্তর বেড়ে গিয়েছিল।
যদিও বুধবারেও পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুরে পৌঁছে ডিভিসি ও ঝাড়খণ্ড সরকারকেই দুষেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জলমগ্ন এলাকা সফরে গিয়ে মমতা এক দিকে যেমন বিষয়টিকে প্রচারের আলোয় আনতে চেয়েছেন, তেমনই দেখাতে চেয়েছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক একা নন, তিনিও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এ জন্য তিনি ফেসবুককেও হাতিয়ার করেছেন। মমতা লিখেছেন, “কাল সন্ধ্যা থেকে আমি রাস্তাতেই রয়েছি। ৪টি জেলা পরিদর্শন করেছি। এমনকী পাইলট কারটুকুও না নিয়ে আমি জেলা সফরে নেমে পড়েছি।” ফেসবুকেও মমতা অভিযোগ করেছেন, রাজ্যকে না জানিয়ে ঝাড়খণ্ড জল ছাড়ায় ৫-৬টি জেলার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।
তবে সেচ দফতরের কিছু ইঞ্জিনিয়ারও মানছেন, অববাহিকার ওপরের দিকে আচমকা প্রবল বৃষ্টি হলে নিম্ন অববাহিকায় থাকা পশ্চিমবঙ্গে জল নামবেই। এই পরিস্থিতিতে কারওকে দোষারোপ করা অর্থহীন।
গোপীবল্লভপুরের বাবুডুমরো গ্রামটি ঝাড়খণ্ড লাগোয়া। স্থানীয় স্কুলে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। সেখানেই দুর্গতদের হাতে ত্রাণ তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “বৃষ্টি আমরা সামলেছি। কিন্তু বৃষ্টিতে বন্যা হয়নি। বন্যা হয়েছে জল ছাড়ার জন্য। ঝাড়খণ্ড আমাদের অনুরোধ শোনেনি। ওরা পাঁচ হাজার, দশ হাজার কিউসেক করে জল ছাড়তে পারত। তা হলে বন্যা হত না। আসলে ওদের কোনও নজরদারি নেই। হঠাৎ মনে হল, লক্ষ লক্ষ কিউসেক জল ছেড়ে দিল।”
গোপীবল্লভপুর থেকে কোলাঘাট যাওয়ার পথে শাশড়ায় একটি ভরা খাল দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। জড়ো হওয়া লোকজনকে ডেকে বলেন, “খালে যে জল যাচ্ছে তা বৃষ্টির নয়। এটা ছাড়া জল। আবার বন্যা হবে।” পাশ থেকে এক জন বলে ওঠেন, “ফের জল ছাড়ছে ঝাড়খণ্ডের গালুডি থেকে।” শুনেই ক্ষিপ্ত মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আবার জল ছাড়ছে? ভেবেছেটা কী?” তার পর জনতার উদ্দেশে বলেন, “যে কোনও সময় বন্যা হবে। সবাই ত্রাণ শিবিরে চলে যান।” কোলাঘাটেই প্রশাসনিক বৈঠক সেরে আরও এক বার ঝাড়খণ্ডের প্রতি ক্ষোভ উগরে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বলেছি এটা মানুষের তৈরি (ম্যান-মেড) বন্যা। বিষয়টি দীর্ঘকালের (ক্রনিক) সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।” সেখান থেকে বেরিয়ে হাওড়ায় উদয়নারায়ণপুরে যান মমতা। সকাল থেকেই সেখানে ছিলেন জেলার তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্থানীয় মানুষ নালিশ জানান, যে পরিমাণ জল ছাড়া হয়েছে তাতে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে তৈরি বাঁধ ভেঙেচুরে গিয়েছে। সব শুনে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বস্ত করেন তাঁদের।
বুধবার সকালে মাইথন থেকে ১৭ হাজার এবং পাঞ্চেত থেকে ৪৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়ে ডিভিসি। ওই সংস্থার এক কর্তা বলেন, “জলাধারগুলিতে জল ধারণ ক্ষমতার বেশি জল আটকে রাখা হয়েছে। পাঞ্চেতের বিপদসীমা ৪২৫ ফুট এবং মাইথনের ৪৫৩ ফুট। কিন্তু এখন সেখানে যথাক্রমে ৪২৬ এবং ৪৯৪ ফুট জল রয়েছে। অর্থাৎ, দু’ক্ষেত্রেই বিপদসীমার উপরে জল আটকে রেখেছে ডিভিসি। ডিভিসি-র চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ সেন এ দিন বলেন, “মানুষের ক্ষতি যাতে না হয় তা দেখেই জল ছাড়া হচ্ছে। একই সঙ্গে জলাধারের অবস্থাও দেখতে হবে।” তিনি জানান, বৃষ্টি না হলে জল ছাড়ার পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে যাবে।
পরিস্থিতির চাপে বিভিন্ন জলাধার থেকে জল ছাড়লে যে রাজ্যের বেশ কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন ডিভিসি-র চেয়ারম্যানও। তাঁর অভিযোগ, দুর্গাপুরে দামোদর নদীর চরে বেআইনি নির্মাণ বাড়ছে। তা না সরানো পর্যন্ত নদীর নাব্যতা বাড়ানোর কাজে হাত দেওয়া যাবে না। রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ঝাড়খণ্ডের বালপাহাড়িতে আমরা একটি নতুন জলাধার তৈরি করছি। এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড দুই রাজ্যের সেচ দফতরের সঙ্গেই আলোচনা চলছে। ওই জলাধারটি তৈরি হয়ে গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, বাম আমলে কোনও নদীনালার সংস্কার হয়নি। এর ফলে অল্প বৃষ্টিতেই সব ভরে যাচ্ছে। জল উপচে পড়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করছে। এই অভিযোগ অবশ্য মানতে চাননি প্রাক্তন সেচমন্ত্রী সুভাষ নস্কর। তাঁর বক্তব্য, “রাজনীতির স্বার্থে অনেক কথা বলা যায়। উনি যদি মনে করেন আমরা নদীর চরে লোকজনকে বসিয়েছিলাম, সরকার উঠিয়ে দিক।”
জল ছাড়ার পরিমাণ কমে গেলেও মঙ্গলবারের মতো এ দিনও দুর্গাপুরে ডিভিসি-র অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল। তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজে কেন্দ্রীয় সেচসচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ রাজ্যের সেচমন্ত্রী দফায় দফায় ডিভিসি আধিকারিকের সঙ্গে আলোচনা করার পরেও কথার খেলাপ করা হয়েছে। এরই প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। তবে কাজে কোনও বাধা দেওয়া হয়নি।”
|
বানভাসি পরিস্থিতিতে কিছুটা স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস। আবহবিদেরা জানান, আজ, বৃহস্পতিবার থেকে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির পরিমাণ কমতে পারে। তবে কয়েকটি জেলায় বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের খবর, মঙ্গলবার বিহারের উপর একটি ঘূর্ণাবর্ত ছিল। দক্ষিণবঙ্গের উপরে সক্রিয় ছিল মৌসুমি অক্ষরেখাও। এই জোড়া ফলায় মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলা ও বিহারে বৃষ্টি হয়েছে। বুধবার ঘূর্ণাবর্তটি ঝাড়খণ্ডের দিকে সরে এলেও তার শক্তি কমেছে। এর ফলেই বৃষ্টি কমতে পারে। বিহার-ঝাড়খণ্ডেও তেমন বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। |