অতি-প্রবল ঘূর্ণিঝড় পিলিনের দাপটে গত কয়েক দিন অঝোরে বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টিতে ফুলেফেঁপে ওঠা বিভিন্ন জলাধার থেকে জল ছাড়া নিয়ে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) এবং পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের ভূমিকায় রুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের ক্ষোভ, তাদের না জানিয়েই খেয়াল-খুশিমতো জল ছাড়া হয়েছে। মঙ্গলবারই সে ক্ষোভের কথা জানিয়ে মমতা চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে। তবে ডিভিসি কর্তৃপক্ষ বা ঝাড়খণ্ড সরকার অভিযোগ মানতে নারাজ। |
পশ্চিম মেদিনীপুরে দাসপুরের বালিপোতায় বাঁধ ভেঙে ঢুকছে কংসাবতীর জল। ছবি: কিংশুক আইচ। |
বস্তুত, ষষ্ঠীর দিন থেকেই এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া শুরু করেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সোমবারেও তিনি কথা বলেন কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের সচিব অলোক রাওয়াতের সঙ্গে। মমতার বক্তব্য, এটা মানুষের তৈরি (ম্যান-মেড) বন্যা, যা এ রাজ্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠানোর আগে রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এ দিনই দুপুরে নিজের বাড়িতে সচিব পর্যায়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে পশ্চিম মেদিনীপুরের বন্যা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে বেরিয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি তিনি রওনা হয়ে যাওয়ায় যথাযথ পাইলটের ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে ঝাড়গ্রাম যেতে গিয়ে প্রথমে পথ ভুলে বেশ খানিকটা এগিয়ে যায় কনভয়। অবশেষে রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী ঝাড়গ্রাম পৌঁছন। রাতেই বৈঠকে বসেন জেলা প্রশাসনের সঙ্গে। ঠিক রয়েছে, আজ বুধবার তিনি সুবর্ণরেখার প্লাবিত এলাকাগুলি ঘুরে দেখবেন। সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় রাতে বলেন, “রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে জল ছাড়ার নালিশ জানাতে কেন্দ্রীয় জল কমিশনকে চিঠি দিচ্ছি। চিঠি দেব ডিভিসি এবং ঝাড়খণ্ড সরকারকেও।”
তবে ডিভিসি-র চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ সেনের দাবি, “জল ছাড়ার আগে রাজ্য সেচ দফতরের সচিব, সংশ্লিষ্ট জেলাশাসক, অতিরিক্ত জেলাশাসকদের আগাম বার্তা দেওয়া হয়। কখনও এসএমএসে, কখনও ফোনে। এ বারেও তেমন ভাবেই জানানো হয়েছে।” তা হলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে বলছেন, এটা ‘ম্যান-মেড’ বন্যা? ডিভিসি চেয়ারম্যানের জবাব, “ম্যাডামের যুক্তি কী, তা বলতে পারব না।”
ডিভিসি-র দুর্গাপুর ব্যারাজ সোমবার থেকে ১ লক্ষ ৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়তে শুরু করে। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার জল ছাড়তে থাকায় মঙ্গলবার দুপুর ১টা থেকে জল ছাড়ার পরিমাণ বাড়িয়ে ১ লক্ষ ৬৩ হাজার কিউসেক করা হয়। পাঞ্চেত ছেড়েছে ৭০ হাজার কিউসেক জল। যদিও দুই জায়গাতেই জল ছাড়ার পরিমাণ সোমবারের থেকে কমেছে। |
দুর্গাপুর ব্যারাজের ছাড়া জলে সকালেই বর্ধমানের কাঁকসার কিছু চর এলাকা প্লাবিত হয়। রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে হঠাৎ জল ছাড়ার অভিযোগ তুলে তৃণমূলের নেতৃত্বে মঙ্গলবার দুর্গাপুরের ডিভিসি কার্যালয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়। বর্ধমানেরই গলসি, খণ্ডঘোষ, রায়না ছুঁয়ে দামোদরের জল নামছে হুগলির আরামবাগে। এ দিন দুপুরেই সেখানে দামোদরের জল চরম বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। রাতের মধ্যেই তা আরও এগিয়ে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ও আমতা-২ ব্লকে পৌঁছে গিয়েছে।
অন্য দিকে, কংসাবতীর জল বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর জলাধার হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে নেমেছে। উপচেছে কেঠে ও শিলাবতী নদী। মুকুটমণিপুর জল ছাড়ার মাত্রা ৫০ হাজার কিউসেক থেকে এ দিনই ২০ হাজার কিউসেকে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু ডিভিসি-র ছাড়া জলে রূপনারায়ণের জলস্তর বাড়ায় প্লাবিত হয়েছে ঘাটাল মহকুমার শতাধিক গ্রাম। সুবর্ণরেখার গালুডি ও কংসাবতী জলাধার জল ছাড়ায় নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, সাঁকরাইল ও দাঁতনের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। ময়ূরাক্ষীর উপরে ঝাড়খণ্ডের মশানজোড় ও বীরভূমের তিলপাড়া ব্যারাজ থেকে ছাড়া জলের পরিমাণ অবশ্য আয়ত্তের মধ্যেই রয়েছে।
দুপুরে উদয়নারায়ণপুরে গিয়ে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতির কাজ করা হচ্ছে। ত্রাণশিবির খোলা ছাড়াও রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরকে দু’টি স্পিডবোট আনতে বলা হয়েছে। সেচমন্ত্রী বলেন, “ডিভিসি আমাদের না জানিয়ে আচমকাই জল ছেড়ে দিয়েছে। জল ছাড়ার পরিমাণ নিয়েও সরকারকে এবং নিজেদের বুলেটিনে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। ডিভিসি-র এই আচরণে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ।” ডিভিসি-র চেয়ারম্যান অবশ্য বলেন, “কেন্দ্রীয় জল কমিশনের নিয়ম মেনেই জল ছাড়া হয়েছে। কমিশনের নিয়ম আছে, প্রয়োজনে যে কোনও জলাধার থেকে আমরা ১ লক্ষ ২৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়তে পারি। কিন্তু আমরা সব সময় কম করেই জল ছাড়ি।”
ঝাড়খণ্ডের জলসম্পদ দফতরের সচিব (পরিকল্পনা) অবিনাশ কুমারও বলছেন, “পিলিন-এর দাপটে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে খরকাই ও সুবর্ণরেখা নদীর জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইতে শুরু করে। পরিস্থিতি আঁচ করে তখন থেকেই আমরা পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি।” তাঁর পাল্টা ক্ষোভ, “কে, কী বলছেন জানি না। ওঁরা বলেছিলেন, কম জল ছাড়তে। কিন্তু কত জল ছাড়া হবে তা আমাদের হাতে নেই। পুরোটাই বৃষ্টির পরিমাণের উপরে নির্ভর করে।” অবিনাশ কুমারের দাবি, ঝাড়খণ্ডের পরিস্থিতি বিচার করেই জল ছাড়া হয়েছিল। এখনও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই কাজ হচ্ছে।
ঝাড়খণ্ডের জলসম্পদ দফতরের এক কর্তা জানান, খরকাই ও সুবর্ণরেখার জল বিপদসীমার উপরে বইতে শুরু করায় চান্ডিল বাঁধের ১৩টি গেট খুলে দেওয়া হয়। তার জেরে পূর্ব সিংভূমের জামশেদপুর ও সরাইকেলা-খারসোঁয়া জেলার বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। মঙ্গলবার অবশ্য চান্ডিল থেকে জল ছাড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আর এ রাজ্যের সেচ দফতরের হিসেবে, ডিভিসি প্রথম জল ছাড়ে গত ১২ অক্টোবর। সে দিন ৬০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়। ১৩ অক্টোবর ৭৬ হাজার কিউসেক জল ছাড়ে ডিভিসি। তার পরের দু’দিন যথাক্রমে ১ লক্ষ ৫৫ হাজার এবং ১ লক্ষ ৬৩ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়। একই সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের গালুডি জলাধারও ১২ অক্টোবর ২ লক্ষ ৫৫ হাজার কিউসেক, ১৩ অক্টোবর ২ লক্ষ ৪৮ হাজার, ১৪ অক্টোবর ২ লক্ষ ১২ হাজার এবং ১৫ অক্টোবর ১ লক্ষ ১৩ হাজার কিউসেক জল ছাড়ে।
রাজ্য সেচ দফতরের দাবি, ডিভিসি এবং ঝাড়খণ্ডের ছাড়া জলেই দুই মেদিনীপুর ও হাওড়া ও বর্ধমানের বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর সূত্রে এ দিন জানানো হয়েছে, কংসাবতী বাঁধে ভাঙন ধরায় পূর্ব মেদিনীপুরের গড়পুরুষোত্তমপুর, রানিহাটি ও পাঁশকুড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলের তলায় চলে গিয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর (১ এবং ২), গোপীবল্লভপুর (১ এবং ২) নয়াগ্রাম, সাঁকরাইল, দাঁতন (১) এবং কেশিয়াড়ি ব্লকের বেশ কিছু এলাকা। সরকারি হিসেবে, জলের তোড়ে ১০ হাজার বাড়ি ভেঙেছে। প্রায় ১২ হাজার বন্যাদুর্গতকে উদ্ধার করে ৬২টি ত্রাণশিবিরে রাখা হয়েছে।
দাসপুর ব্লকের বালিপোতার মাঝপাড়ার লক্ষ্মী দোলই, সামাটের পুতুল সামন্তরা বলেন, “সকাল থেকে প্রশাসনের কারও দেখা নেই। বাড়ি থেকে যা বার করতে পেরেছি, তা নিয়ে উঁচু রাস্তায় এসে উঠেছি। কাঁসাইয়ের জলে সব ভেসেছে।”
|
বন্যা পরিস্থিতির সঙ্গেই ফের হাজির বৃষ্টির ভ্রূকুটি। সৌজন্য ঘূর্ণাবর্ত ও মৌসুমি অক্ষরেখার জোড়া দাপট। বিভিন্ন জলাধার থেকে জল ছাড়ার ফলে জলমগ্ন হয়েছে হুগলি ও পশ্চিম মেদিনীপুর-সহ কয়েকটি জেলার একাংশ। এর মধ্যেই আজ, বুধবার ফের রাজ্যে বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠতে পরে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবহবিদেরা জানান, বর্ষার শেষ লগ্নে দক্ষিণবঙ্গে মৌসুমি অক্ষরেখা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিহারের উপর রয়েছে ঘূর্ণাবর্তও। এই দু’য়ের প্রভাবে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টি হতে পারে। বিহারের কোনও কোনও এলাকায় ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। |