টানা বৃষ্টি ও হাওয়ার দাপটে কাদা ভরা জমিতে নুইয়ে পড়েছে ধানগাছ। কোথাও আবার বিঘের পর বিঘে ধান জমি জলের তলায়। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন এমনই অবস্থা। ফলে দুর্গাপুজোর পরেই এই জেলার চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে।
জেলা কৃষি দফতর সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই তাদের কাছে কয়েকশো হেক্টর জমির ধান ও শাক-সব্জি নষ্ট হওয়ার খবর এসেছে। তার মধ্যে কয়েকশো বিঘে জমির আমন ধান জলের তলায় ডুবে রয়েছে। তবে জল দ্রুত নামতে শুরু করায় ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমার সম্ভাবনাও রয়েছে। এ দিকে যে সব এলাকার মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই বুধবার ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে ত্রাণ শিবিরগুলি অবশ্য এ দিন চালু ছিল। প্রশাসন জানিয়েছে, গত তিন দিনের তুলনায় বুধবার জেলার জলমগ্ন এলাকার পরিস্থিতির ক্রমশ উন্নতি হয়েছে। বাঁকুড়ার জেলাশাসক বিজয় ভারতী এ দিন সারেঙ্গার কয়েকটি ত্রাণশিবির পরিদর্শন করেন। পরে বলেন, “সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে জেলায় প্রায় ৩০০ কাঁচা ঘর ভেঙেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ২১০০ ঘর। নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করা হবে।” |
জেলার উপ-কৃষি অধিকর্তা (বিশ্বব্যাঙ্ক প্রকল্প) অশ্বিনীকুমার কুণ্ডু জানান, এ বছর তিন লক্ষ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। তার মধ্যে আউশ ধান চাষ হয়েছে ৩১ হাজার ২৫২ হেক্টর জমিতে। বাকি জমিতে আমন ধানের চাষ হয়েছে। তিনি বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে এক নাগাড়ে বৃষ্টির সঙ্গে ডিভিসি-র দুর্গাপুর ব্যারাজ ও কংসাবতী নদীতে মুকুটমণিপুর জলাধার থেকে জল ছাড়া হয়েছে। এর ফলে জেলার বেশ কয়েকটি ব্লকে আউশ ধানের ও কাঁচা সব্জির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে জল দ্রুত নামতে শুরু করায় যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তার থেকে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কম হবে।”
জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বছর ১১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে খরিফ চাষ হয়েছে। বৃষ্টির জন্য প্রায় ১২০০ হেক্টর জমির খরিফ ফসল নষ্ট হতে বসেছে। একই সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বড়জোড়া ব্লকের মানাচর, সোনামুখীর ডিহিপাড়া, ধুলাই, নবাসন, উত্তর বেশিয়া, পাত্রসায়রের পাঁচপাড়া, শালখাঁড়া, সারেঙ্গার বেলেপাল, মাজুরিয়া এলাকার বেশকিছু জমি এখনও জলের তলায় রয়েছে। ওইসব এলাকার জমির ধান ও সবজি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ দিকে আউশ ধান পাকতে শুরু করেছে। সাধারণত এই সময়ে আউশ ধান কাটা হয়। বৃষ্টিতে আউশ ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ দিন পাত্রসায়রের বেশকিছু এলাকায় ঘুরে দেখা গিয়েছে, ধানগাছ জমিতেই নুইয়ে পড়েছে। জলের মধ্যেই ডুবে রয়েছে ধানের শিষ। পাত্রসায়রের চরগোবিন্দপুরের চাষি রমেন সরকারের আশঙ্কা, “জল-কাদায় কি আর ধান ঠিক থাকবে! ওই ধান আদৌ খাওয়ার যোগ্য থাকবে বলে মনে হয় না।” হতাশ সারেঙ্গার চাষি বিধান মণ্ডল, অরিজিৎ প্রতিহাররাও। তাঁরা বলেন, “সমবায় সমিতির কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চাষ করেছিলাম। জলের তোড়ে আমাদের জমির ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন সারা বছর কী খাব? কী ভাবেই বা ধার শোধ করব?” |
অষ্টমীর দিন থেকেই জেলাজুড়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। তার উপর দুর্গাপুর ব্যারাজ থেকে দামোদর নদে এবং মুকুটমণিপুর জলাধার থেকে কংসাবতী নদীতে জল ছাড়া শুরু হতেই বিপত্তি আরও বেড়ে যায়। দামোদর তীরবর্তী বড়জোড়া ও সোনামুখী ব্লকের বেশকিছু গ্রামে জল ঢুকে পড়ে। জেলায় কয়েক হাজার কাঁচা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকেই গৃহহীন হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি সামাল দিতে বড়জোড়া, সোনামুখী ও সারেঙ্গা ব্লকে কয়েকটি ত্রাণ শিবির খুলে জলবন্দি মানুষদের উদ্ধার করে আনা হয়। খাতড়ার মহকুমাশাসক শুভেন্দু বসু বলেন, “পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সারেঙ্গার ত্রাণশিবিরগুলি থেকে অনেকেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।”
এরই মধ্যে মুকুটমণিপুর জলাধার থেকে জল ছাড়ার হার কমানো হয়েছে। কংসাবতী সেচ দফতরের সুপারিন্টেডিং ইঞ্জিনিয়ার (১) বিশ্বনাথ কুমার বলেন, “মুকুটমণিপুর জলাধারে এ দিন দুপুর পর্যন্ত জলস্তর ছিল প্রায় ৪৩৮ ফুট। তা সত্ত্বেও এলাকার পরিস্থিতির কথা ভেবে জল ছাড়ার হার ২০ হাজার কিউসেক থেকে কমিয়ে পাঁচ হাজার করা হয়েছে। এতে বিপদের কোন আশঙ্কা নেই।” তবে জল ছাড়ার পরিমাণ কমানো হলেও খাতড়ার কেচোন্দাঘাটে কজওয়ে থেকে জল নামেনি। এ দিনও ওই কজওয়ের উপর দিয়ে তীব্র স্রোতে জল বইতে থাকায় খাতড়া থেকে সাহেববাঁধ হয়ে রানিবাঁধ ও রাইপুর যাওয়ার রাস্তা বন্ধ থাকে। সারেঙ্গার বিডিও হীরকজ্যোতি মজুমদার বলেন, “ব্লকের পাঁচটি ত্রাণশিবির থেকেই মানুষজন বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে কয়েকজনের বাড়ি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তাঁরা আপাতত শিবিরেই রয়ে গিয়েছেন।”
সোনামুখীতেও অনেকেই এ দিন ত্রাণ শিবির থেকে বাড়ি ফেরেন। সোনামুখীর বিডিও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “লালবাবার চর, উত্তর চর ও উত্তর বেশিয়ার চরে এ দিনও ত্রাণশিবির চালু রয়েছে। তবে জল নামতে শুরু করায় দুর্গতদের অনেকেই বাড়ি ফিরে যান।” |