কোনও না কোনও একটা সংসার ছিল। আর যেমনই হোক, সেই সংসারে জগজ্জননীর আলোর ছটা এসে পড়ত। পুজো। পুজোর পরে বিজয়া। তারপরে লক্ষ্মীপুজো। যতটুকু সম্ভব আয়োজন থাকত।
এখন দশমী রয়েছে। বিজয়ার সেই আলোটুকু নেই।
জয়া শীলের মনে পড়ে যায়, ঠাকুরদালানের সব থেকে নীচের চওড়া সিঁড়ির উপরে জলচৌকি পেতে বসতেন সাতক্ষীরার শীল বাড়ির কর্তা মা। পরনে কস্তা পেড়ে গরদের নতুন শাড়ি। কাছে ঘেঁসে বসতেই পাওয়া যেত কর্তা মা-র নিজস্ব একটা গন্ধ। সুগন্ধী তেল, চন্দন আর খাঁটি ঘিয়ের সেই গন্ধ আরও যেন বেশি করেই পেতেন জয়া। তাঁর তখন নাম ছিল আনন্দী। বসতেন কর্তা মা-র কোলে। পাড়া ভেঙে লোক আসতেন কর্তা মা-কে দেখতে। তাঁরা প্রণাম করতেন কর্তা মা-কে। আর তাঁর বড় নাতির মেয়ে ছোট্ট আনন্দীও তখন পেত সেই সুখভোগের ভাগ। আর একটু বড় হলে বড় পিতলের থালা থেকে ক্ষীরের নাড়ু তুলে দিত সে তিন গ্রামের মানুষের হাতে।
নবদ্বীপের ভজনাশ্রমে এখন ঠাসাঠাসি ভিড়ের লাইনে যখন ভিক্ষালব্ধ মিষ্টির থালা হাতে নিয়ে হাঁটেন সেই আনন্দী, তাঁর মনে পড়ে যায় কর্তা মা-র কথা। সেই বিরাট এক সংসারে তাঁরও ছিল নির্দিষ্ট স্থান। এখন মঠ-মন্দিরের বিরাট সংসারের হাজারো আনন্দীর মধ্যে তাঁর পরিচয় গৃহহীন এক বৃদ্ধা। জয়া বলেন, “এগারো বারো বছর পর্যন্ত রাজকন্যার মতো জীবন কাটিয়েছি। তারপরেই সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। কর্তা মা মারা গেলেন। সবাই পৃথক অন্ন হয়ে গেল। তারপরে দেশভাগ। উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় মিলল। তখনও খুব বড় হইনি।” কলোনিতেই বিয়ে হয়েছিল। জয়া বলেন, “খুবই দুঃখের সংসার ছিল। কিন্তু সেখানেও পুজো আসত। বিজয়া হত।” তারপর? জয়া আর কথা বলতে চান না। মুখ ঘুরিয়ে নেন। সেই ভাবেই বলেন, “ছেলে কাজের খোঁজে গুজরাত যাওয়ার আগে আমাকে এখানে রেখে দিয়ে চলে গিয়েছে।” আর আসেনি? জয়া প্রত্যয়ের সুরে বলেন, “নিশ্চয়ই আসবে। কোনও একদিন।” সেই ছেলের মঙ্গলকামনাই করেন এখনও প্রতিদিন। |
ভজনাশ্রমে ভিড় জমেছিল হাজারখানেক এমন অনাথ বৃদ্ধার। মঠ-মন্দিরে নামকীর্তন করে দু’বেলা অন্নোপার্জন করেন তাঁরা। তাঁদেরই একজন কনকদাসী বলেন, “বারো মাসে তেরো পার্বন। প্রতিবার নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে কত সামান্য আয়োজনে কাজ করতাম। আসলে আমরা কিছুই ভুলিনি। সংসার আমাদের ভুলে গিয়েছে।” ঝর্না দেবনাথ জানান, তাঁদের বাড়িতে খুব বড় করে লক্ষ্মীপুজো হত। বিজয়া থেকেই শুরু হয়ে যেত তার আয়োজন। নানা খাবার তৈরি হত।” স্বামী মারা যাওয়ার পরে ছেলের সংসারে তাঁরও আর স্থান হল না। বিজয়ার প্রণামটুকুও করত না কেউ। ঘেন্নায় নিজেই চলে আসেন নবদ্বীপে।
মাধবী বিশ্বাস, ছবিদেবী, কনকদেবী সকলেই নানা এমনই জীবনের কাহিনি বলেন। সরলা দাস বলেন, “শ্বশুরবাড়িতে দুর্গা পুজো হত। এক দিন বড় ডাকাতি হল। বাধা দিতে গিয়ে মারা পড়লেন শ্বশুর, স্বামী। তারপর থেকেই বাড়ির অবস্থা পড়তে শুরু করল। শেষের দিকে সকলে ফুটো জাহাজ ছেড়ে যে যার মতো করে পালালেন। আমার কোনও যাওয়ার জায়গা তখন আর নেই। চলে এলাম নবদ্বীপে। এক কালে নিজের হাতে হাজার লোকের জন্য খিচুড়ি রাঁধতাম, এখন হাজার লোকের লাইনে দাঁড়িয়ে এক থালা খিচুড়ি পেলে সে দিনের মতো পেট ভরে।”
হঠাৎ শুনলে মনে হয়, কেউ হয়তো বাড়িয়ে বলছেন। ফেলে আসা দিন যেন স্বপ্নের মতো রঙিন। কিন্তু কারও কারও হাতের মুদ্রায়, আচরণে, কথার বাঁধুনিতে, শব্দচয়নে নিশ্চিত আভিজাত্যের ছাপ নজর এড়াতে পারে না। নবদ্বীপের বিধায়ক মন্ত্রী পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা সম্প্রতি এই বিধবাদের সাত রকম মিষ্টি দিয়ে প্রণাম করেছেন। তখনও দানগ্রহণের সময়ে, তাঁদের আচরণে ছিল সেই সম্ভ্রান্ত সংসারের অমোঘ চিহ্ন। তবে সম্ভ্রান্ত হোন বা না হোন, নবদ্বীপের হাজারো ভিক্ষান্নজীবী বৃদ্ধারা এই সব উৎসবের দিনের জন্য আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করেন। এই দিনগুলোয় দান মেলে বেশি। কিন্তু এই দিনগুলোতেই বেশি করে মনে পড়ে যায় নিজেদের সংসারের কথা। |