|
|
|
|
বাড়ছে নদীবাঁধের ফাটল, কোমর জলে ডুবে বালিপোতা |
অভিজিৎ চক্রবর্তী • দাসপুর |
কোমর পেরিয়েছে জল। তারই মধ্যে বুকের কাছে থলে আঁকড়ে বাজার যাচ্ছেন সামাটের আশিস বটব্যাল। দাসপুরের বালিপোতা গ্রামে কংসাবতী নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে তাঁদের গ্রামে। জল ঢুকেছে বাড়িতেও। গ্রামেরই একটা উঁচু জায়গায় অন্যের বাড়িতে মাথা গুঁজেছেন আশিসবাবু ও তাঁর পরিবার। কিন্তু খেতে তো হবে, খাওয়াতে হবে। অগত্যা হাতড়ে হাতড়ে বাজারের পথ ধরেছেন আশিসবাবু। বললেন, “চাষবাসের সঙ্গে টিউশন করে দিন চলে কোনও রকমে। আচমকা বিপর্যয়ে মহাবিপদে পড়েছি। হাতে টাকাকড়িও বিশেষ নেই। দেখা যাক ভাগ্যে কী আছে। বাজারে কিছু পাই কি না।”
আশিসবাবুর পিছনে জল ভেঙে বাজারে যেতে দেখা গেল আরও অনেককেই। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঘাটাল মহকুমার এই সব এলাকায় যে ফি বছরই বন্যা হয়,তা নয়। নিচু এলাকা হওয়ায় বেশি বৃষ্টি হলে মাঠে-রাস্তায় জল জমে যায় শুধু। তাই বন্যা পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত নন এলাকার মানুষ। মঙ্গলবার সকাল ন’টার সময় আচমকাই জমিদারি বাঁধ ভেঙে কংসাবতীর জল বালিপোতা গ্রামে ঢুকে পড়লে প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন এলাকাবাসী। পরে ওই গ্রাম টপকে পাশাপাশি গ্রামগুলিতে জল ঢোকে। রাতের মধ্যেই বালিপোতা-সহ দাসপুর-১ ব্লকের নাড়াজোল ও রাজনগর পঞ্চায়েতেরপ্রায় ৩০টি গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়ে। |
|
ঘাটাল-মেদিনীপুর ভায়া নাড়াজোল সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন দুর্গতরা। —নিজস্ব চিত্র। |
নিচু এলাকা বলে এখানে ঘরবাড়ি একটু উঁচুতে। তাই অনেকেই রক্ষা পেয়েছেন। আবার অনেকেরই বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে। মাটির কিছু বাড়ি ভেঙেও গিয়েছে। এই সব পরিবারগুলি কেউ পড়শিদের বাড়ি, কেউ বা আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ ত্রাণশিবিরে। স্থানীয় বালিপোতা প্রাথমিক স্কুলে এবং সামাট কালিতলাতে ত্রাণশিবির খুলেছে প্রশাসন। মঙ্গলবার শতাধিক মানুষ ভয়ে বাড়ি ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে চলে এলেও বুধবার দু’টি শিবিরে মোটের উপর ৫০-৬০ জন রয়েছেন। বালিপোতার বাবলু সিংহ বলেন, “আমরা বাড়িতেই ছিলাম। হঠাৎ হই-হট্টগোল শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি বাড়ির সামনে বাঁধ ভেঙেছে। কোনও রকমে ত্রাণ শিবিরে চলে এসেছি। বাড়ি থেকে সে ভাবে কিছু আনতে পারিনি।”
এদিকে বাড়িতে থাকলেও সমস্যার শেষ নেই। নেই বিদ্যুৎ। পানীয় জলেরও সমস্যা। বেশিরভাগ বাড়িতেই নৌকা নেই। ফলে দিন চালানোর জন্য বুক ভর্তি জল পেরিয়ে বাজারের পথে কিসমত নাড়াজোলের অশোক মাইতি, মদন ভুঁইয়া, আমডাংরার ভক্তি দোলইরা। সামাটের কল্পনা দোলই বলেন, “বাজারে সব্জি বিক্রি করে আমার সংসার চলে। আর এখন বাজারে যেতে হচ্ছে নিজেকেই আলু-পেঁয়াজ কেনার জন্য।” |
জল-যুদ্ধ
|
বাঁধ ভেঙে কংসাবতীর জল ঢুকেছে গ্রামে। জলমগ্ন গ্রামে ঢোকার রাস্তাও।
তাই দাসপুরের কালীনগর
গ্রামে
নিত্য প্রয়োজনের জিনিস নিয়ে জল পেরিয়েই বাড়ি ফেরা। ছবি: কিংশুক আইচ। |
প্রশাসন অবশ্য দাবি করছে, মঙ্গলবার রাত থেকেই পর্যাপ্ত নৌকা, জলের প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে বন্যাদুর্গত এলাকাগুলিতে। ঘাটালের মহকুমাশাসক অদীপ রায় বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। তবে গ্রামে জল ঢুকলে যা সমস্যা হয়, তা তো হচ্ছেই। আমরা সরকারি ভাবে ত্রাণ শিবির থেকে পানীয় জল, শুকনো খাবার, নৌকাসবই দিয়েছি। নৌকায় করে গ্রামগুলিতে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের লোকজন ঘোরাঘুরি করছেন।” এদিন বিকালে ঘাটালের বিধায়ক শঙ্কর দোলই একাধিক নৌকা ভর্তি ত্রাণ নিয়ে বালিপোতা-সহ আশপাশের গ্রামে বিলি করেছেন।
ত্রাণ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গজগজ করছিলেন একদল গ্রামবাসী। এক যুবক বলেন, “শুকনো খাবার নিয়ে কী করব? বাড়িতে এক কোমর জল। লোকের বাড়িতে ক’ দিন থাকা যায়। ত্রাণ বিলির বদলে প্রশাসন বাঁধ সারানোয় মন দিলে ভাল হত।”
বস্তুত ঘাটাল মহকুমার জমিদারি বাঁধগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বালিপোতায় যেখানে বাঁধ ভেঙেছিল, সেটি ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। তা মেরামতের কোনও উদ্যোগ নেই। এমনকী মাসকয়েক আগে দাসপুরের ধর্মায় যেখানে কংসাবতীর বাঁধ ভেঙেছিল, সেটিও এখনও সারানো হয়নি। জমিদারি বাঁধ দেখভালের দায়িত্ব তাদের নয় বলেই দায় সেরেছে সেচ দফতর। ঘাটালের বিধায়ক শঙ্কর দোলই আশ্বাস দেন, “জল কমলেই মহকুমার সমস্ত জমিদারি বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু হবে।”
এ দিকে শিলাবতী নদীতে জল বেড়েই চলছে। প্রশাসন সূত্রের খবর, গোটা মহকুমার পাঁচটি ব্লকের ১৪টি পঞ্চায়েতের ১২০-১৩০টি গ্রাম জলের তলায়। তার মধ্যে ঘাটাল ব্লকে ৮টি, দাসপুর-১ ব্লকে ৩টি, চন্দ্রকোনা-২ ব্লকে ২টি এবং চন্দ্রকোনা-১ ব্লকের ১টি পঞ্চায়েত রয়েছে। মাস দু’য়েকের মধ্যে পরপর বন্যায় মহা সমস্যায় পড়েছেন এই সব এলাকার লোকজন। বিশেষ করে ফসল থেকে সব্জিসবই নষ্ট। কাজ নেই শ্রমিকদেরও। বাস বন্ধ থাকায় শুধু যাত্রীদেরই নয়, বাস মালিক ও কর্মীদেরও দুর্দশা। বন্যায় এখনও পর্যন্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের নাম কৌশর আলি খান (৩৭)। বাড়ি বীরসিংহ পঞ্চায়েতের বোয়ালিয়া গ্রামে। |
|
|
|
|
|