|
|
|
|
পাঁশকুড়ায় ফের নদীবাঁধ ভেঙে ছন্দহীন জনজীবন |
অমিত করমহাপাত্র • পাঁশকুড়া |
মাত্র পঞ্চাশ দিনের ব্যবধান। তারই মধ্যে একই জায়গায় দু’-দু’বার বাঁধ ভাঙল পাঁশকুড়া পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের রানিহাটিতে। তাতে ফের বিপর্যস্ত হল ক্রমশ ছন্দে ফিরতে থাকা জনজীবন।
গত ২৪ অগস্ট কাঁসাই নদীর বাঁধ ভেঙে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া ও তমলুক ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়েছিল। মেরামতির কাজ চলাকালীন মঙ্গলবার দুপুরে ফের ওই বাঁধ ভাঙে। সেই ভাঙন ৩০ ফুট থেকে শুরু হয়ে বুধবার তা ১২০ ফুট ছাড়ায়। জেলা প্রশাসনের হিসাবে, শুধুমাত্র পাঁশকুড়া ব্লকেই পাঁশকুড়া পুরসভা (১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৬ সম্পূর্ণ এবং ৬, ৭, ৮, ১০ আংশিক, মোট নয়টি ওয়ার্ড) এবং ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা মিলিয়ে ৭৪টি মৌজা জলমগ্ন হয়েছে। পুজোর আগে রাধাবন এলাকায় ক্ষীরাই নদীর বাঁধ ভেঙে হাউর, ঘোষপুর, চৈতন্যপুর ১ ও ২-সহ ৩০টি মৌজা জলমগ্ন হয়েছিল। তমলুক ব্লকের হরিদাসপুর থেকে রাজনগর কিংবা পাঁশকুড়ার পুরুষোত্তমপুর থেকে চিল্কা পর্যন্ত রাস্তার জল কয়েক দিন আগেই নেমেছিল। নদীবাঁধ ভাঙায় ফের ওই রাস্তায় জলের তলায় চলে গিয়েছে। বাঁধ ভাঙার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রতাপপুর ২, রাধাবল্লভচক, পুরষোত্তমপুর সম্পূর্ণ ভাবে এবং রঘুনাথবাড়ি, প্রতাপপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ তমলুকের অনন্তপুর ১ ও ২, শ্রীরামপুর ১ ও ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের কিছু এলাকা আংশিক জলমগ্ন হয়েছে। এ দিন বিকালে জল ঢুকতে শুরু করেছে বিষ্ণুবাড় ১ ও ২ এবং নীলকুণ্ঠা, খণ্ডখোলা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। তমলুকের ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। এর জেরে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা। |
|
পাঁশকুড়ায় আটবেড়িয়ায় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস। |
বাড়িতে জল ঢুকে যাওয়ায় ঘর ছেড়ে পাশের উঁচু রাস্তায় এসে উঠেছেন পাঁশকুড়া পুরসভার অর্ন্তগত পাঁশকুড়া ১ ব্লকের গড়পুরুষোত্তমপুরের পুলিন মান্না, প্রতাপপুরের শেখ ইউনুসরা। রাস্তার গাছ কেটে, সরকারি ত্রিপল টাঙিয়ে কোনও রকমে গবাদিপশু-সহ সপরিবারে মাথা গোজার ঠাঁই করে নিয়েছেন তাঁরা। উপর্যুপরি দু’দুবার একই জায়গার বাঁধ ভাঙায় একই সঙ্গে হতাশ ও ক্ষুব্ধ তাঁরা। দুর্গতদের পক্ষে পুলিনবাবু ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “পরপর দু’বার বাঁধ ভাঙায় আমাদের সবারই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়ি, কৃষিজমি জলের তলায়। ক্ষতিপূরণ পেলেও যা হারিয়েছি, তা পূরণ হবার নয়।” সরকারের কাছে তাঁদের দাবি, বাঁধ পাকাপাকি ভাবে মেরামত করা হোক এবং বাঁধ ভাঙার তদন্ত করা হোক। একই দাবি রানিহাটির ভোলানাথ চক্রবর্তী, কার্তিক দোলুইদের। তাঁদের আবার অভিযোগ, “গতবার বাঁধ ভাঙার পর ভালোভাবে বাঁধ বাঁধা হয়নি। আমরা বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে অনেক চেষ্টা করেও বাঁধের ভাঙন আটকাতে পারিনি।” কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বলাকা মঞ্চে প্রশাসনিক সভার পর নদীবাঁধ ভাঙন প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গতদের আশ্বস্থ করে বলেন, “যাঁদের গাফিলতিতে বাঁধ ভেঙেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রতাপপুরের ১১ নং ওয়ার্ডের চক্রবর্তী পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল প্রায় কোমর জলে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে স্রোতের ঠেলা থেকে বাঁচতে হাতে হাত দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা কেউবা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে কেউবা মালপত্র নিরাপদ জায়গায় রাখার জন্য জোটবদ্ধ ভাবে চলেছেন। রানিহাটির বাসিন্দা শেখ সফিউল্লা, ফরিদন বিবি, শেখ কেরামত, রেশমা বিবিরা বাঁধ ভাঙার খবর পেয়েই ছুটেছিলেন উঁচু জায়গায় উদ্দেশে। তাঁদের কথায়, অগস্টে যখন বাঁধ ভেঙেছিল তখন নদীর জল ঢুকতে প্রায় দু’-তিন দিন সময় লেগেছিল। কিন্তু, এ বার এত দ্রুত জল ঢুকেছে যে বাড়ি থেকে কোনও জিনিসপত্রই বার করতে পারেননি। শুধু প্রাণটা বাঁচিয়েছেন। রেশমাবিবির আক্ষেপ, “খুশির ইদ আর খুশির থাকল না।”
এ দিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাত জেলাশাসক অন্তরা আচার্য, অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) অজয় পাল, সেচ দফতরের মুখ্য বাস্তুকার (২) বরণ ঘোষ, সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়র সুবীর লাহা এবং সেনাবাহিনীর আধিকারিকরা ভাঙা বাঁধ এলাকা (রানিহাটি) পরিদর্শনে যান। জানা গিয়েছে, তখন সেখানে রাস্তার উপর আশ্রয় নেওয়া ক্ষুব্ধ দুর্গতরা জেলাশাসককে প্রশ্ন করেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন? আগে এলে এ ভাবে আমাদের ভুগতে হত না।’ সরাসরি জবাব এড়িয়ে এগিয়ে যান জেলাশাসক অন্তরা আচার্য। পরে তিনি দুর্গতদের আশ্বস্থ করে বলেন, “এখনকার মতো কাজ করতে দিন। পরে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব।” বাঁধ মেরামতি প্রসঙ্গে সেচ দফতরের মুখ্য বাস্তুকার বরণ ঘোষ বলেন, “বুধবার থেকে বাঁধ মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে। ইট ও বালি দিয়ে বাঁধ আরও চওড়া করা হচ্ছে। বুধবার ২৫ ফুট বাঁধ মেরামতির লক্ষ্য মাত্রা নেওয়া হয়েছে। পুরো কাজ শেষ করতে শুক্রবার হয়ে যাবে।”
পরে সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়র এবং সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ররা যৌথ ভাবে লোহার তারের খাঁচায় ইট ভরে বাঁধ মেরামতির কাজ শুরু করেন। এ দিকে বাঁধ সম্পূর্ণ না বাঁধা অবধি জল বাড়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। তবে আশার কথা কাঁসাই নদীর জলস্তর ধীরে ধীরে নামছে। বুধবার নতুন করে আর বৃষ্টিও হয়নি। তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাঁধ মেরামতির কাজ শেষ হবে।” প্রসঙ্গত, এ দিনই শুভেন্দু অধিকারীর উদ্যোগে দুর্গতদের রান্না করা খাবার বিলি করা হয়।
অন্য দিকে, সুবর্ণরেখার জল উপছে কাঁথি মহকুমার রামনগর ১ ব্লকের বাধিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ৬টি গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে। সুবর্ণরেখা তীরবর্তী বাধিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের কচুয়া, বারবাটিয়া, পদুবাড়, কাণ্ডগ্রাম, বাখারপুর ও উত্তর বাধিয়া গ্রামগুলি বর্তমানে ১০ থেকে ১৭ ফুট জলের তলায় বলে ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক তমোজিৎ চক্রবর্তী জানিয়েছেন। কচুয়া গ্রামের দোতলা শিশুশিক্ষা কেন্দ্র জলে ডুবে রয়েছে বলেও তিনি জানান। জলের তলায় চলে গিয়েছে একের পর এক গ্রামের কৃষিজমি, বসতি এলাকা। জলবন্দী হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ইতিমধ্যেই প্রায় পাঁচশো জনকে উদ্ধার করে ত্রাণ শিবিরে রাখা হয়েছে। পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য খালেক আবদুল কাজী জানিয়েছেন, “বাধিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে চারটি স্কুলে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে।” বাধিয়া-মীরগোদা-রাস্তা-সহ বাধিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার সব রাস্তাই জলায় তলায়। রামনগর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নিতাই সার জানিয়েছেন, “পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে নৌকা চালু করার চেষ্টা করা হলেও নৌকা না মেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।” |
তথ্য সহায়তা আনন্দ মণ্ডল। |
|
|
|
|
|