তিনশো পেরোনো ইনিংসকে সম্ভ্রমের চোখে দেখার আর বিন্দুমাত্র যুক্তি নেই। বুধবারের জয়পুরে শিখর-রোহিত-বিরাটের লাগাতার গোলাবর্ষণে ৩৫৯ রানের অস্ট্রেলীয় দুর্গকে ফুটিফাটা হয়ে ভেঙে পড়তে দেখে কথাটা এ বার হয়তো চোখ বুজে লিখে ফেলাই যায়।
বত্রিশ বছর আগে, ১৯৭১-এর অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ড আন্তর্জাতিক ম্যাচ দিয়ে যে নতুন ফর্ম্যাটের সূচনা দেখেছিল ক্রিকেটবিশ্ব, সময়ের পথ ধরে সেটা এত দিন আশ্চর্য ভাবে পাল্টাচ্ছিল ঠিকই। ২০০৬-এ হার্শেল গিবসের মহাকীর্তিতে অস্ট্রেলিয়ারই ৪৩৪ রানের এভারেস্টকে টপকে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওটাকে ব্যতিক্রম বলে ধরা হত। নিয়ম নয়। বরং নিয়মটা তৈরি হচ্ছিল গত কয়েক বছর ধরে, যখন তিনশো রান করেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছিল না কোনও দলই। সেটাকেই আরও এক বার প্রমাণ করে দিল এ দিন মরু-শহরের দিনরাতের ম্যাচ। প্রশ্ন উঠল, টি-২০র দুনিয়ায় তা হলে কি এ ভাবেই বদলে যাবে ওয়ান ডে?
ম্যাচের পর রবি শাস্ত্রী বলেই ফেললেন, “এরা তো ওয়ান ডে ম্যাচটাকে টি-টোয়েন্টিতে নামিয়ে এনেছে। যে ভাবে ব্যাট করে, মনে হল তিনশো-সাড়ে তিনশোও কিছু নয়। মনে হল, টি-টোয়েন্টি দেখলাম।” |
বুধবারের জয়পুরের পর মনে হচ্ছে, কোথায় সেই বাঁধাধরা ওয়ান ডে ম্যানুয়াল? যেখানে লেখা থাকবে, এখানে সাতের বেশি রান রেট মানে তুমি খতম? কোথায় সেই সব শাসানি, যেখানে বলা হবে টি টোয়েন্টিতে বিপক্ষের সেরা বোলার হাতে পাচ্ছে মোটে চার ওভার, এখানে কিন্তু দশটা ওভার। অতএব ওয়ান ডে-তে টেকনিক ছাড়া বেরোনো যাবে না? নাকি ওয়ান ডে মানে আর নিছক রঙিন জার্সি-সাদা বলের পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট নয়! ওটাও সময়-বিবর্তনে গঠন পাল্টে আদতে হয়ে পড়ে টি-টোয়েন্টি! ঘাড়ের উপর ৩৫৯-এর হিমশৈল থাকলেও অনায়াসে দেখানো যায় বুড়ো আঙুল, ম্যাচ শেষ করে দেওয়া যায় কি না ৩৯ বল বাকি থাকতে! জেতা যায় হাতে ন’টা উইকেট রেখে! সাড়ে তিনশো রানের চাপে গলা পর্যন্ত ডুবে গিয়েও করে ফেলা যায় দু-দু’টো সেঞ্চুরি!
দশ বছর আগে এক বিশ্বকাপ ফাইনালে এক বাঙালি অধিনায়কের সামনে ঠিক এই একই স্কোর তুলেছিল রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া। ৩৫৯। আজ সে দিনের সেই অধিনায়কের সামনে ওই একই প্রতিপক্ষের, একই স্কোরের ঔদ্ধত্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেল মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভারত। চাপ বা গুরুত্বের বিচারে দু’টো ম্যাচের কোনও তুলনা চলে না, কিন্তু কমেন্ট্রি বক্সে বসে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এ দিন দেখে ফেললেন, অন্তত সংখ্যার বিচারে অস্ট্রেলিয়াকে কেমন গুঁড়িয়ে দেওয়া গেল!
সৌরভের ক্রিকেটজীবনেই তিনশো তাড়া করে জেতা দু’টো অবিস্মরণীয় ম্যাচ রয়েছে। একটা ঢাকায় ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ ফাইনাল, অন্যটা সেই লর্ডসে জার্সি ওড়ানো ন্যাটওয়েস্ট ফাইনাল। যথাক্রমে পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের মতো দুই বাঘা প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিয়ে দাপুটে জয়।
এর পাশেই রাখুন আশি ও নব্বইয়ের দশককে। তখন ব্যাপারটা এমন ছিল যে, ওয়ান ডে-তে প্রথমে ব্যাট করা টিম আড়াইশো পেরোনো মানে বিপক্ষের ধুকপুকুনি শুরু। ইডেনে ’৮৭-র বিশ্বকাপ ফাইনালে বর্ডারের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২৫৩ তুলতে পারেনি ইংল্যান্ড। ’৯২ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইমরানের দল করেছিল ২৪৯। জবাবে ইংল্যান্ড শেষ করে ২২৭-এ। ঠিক পরের বিশ্বকাপেই তেড়েফুঁড়ে আবির্ভূত হন জয়সূর্য-কালুভিথারানা ওপেনিং জুটি। তাঁদের দাপটে কোটলায় ২৭১ তুলেও ম্যাচ বাঁচাতে পারেনি ভারত। প্রথম পনেরো ওভারে ফিল্ডিংয়ের বিধিনিষেধের সুযোগ নিয়ে ওপেনারদের দেদার ধুমধাড়াক্কার সার্থক বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান জুটি। এর অব্যবহিত পরেই আত্মপ্রকাশ করেন ভারতের কিংবদন্তি ওয়ান ডে ওপেনিং জুটি সচিন-সৌরভ। পাকিস্তানের আমির সোহেল-সইদ আনোয়ারও তখন সমান তালে ত্রাস ছড়াচ্ছেন।
তত দিনে রান তোলার ধরনও বদলে দিয়েছেন মাইকেল বিভানের মতো কিছু অত্যন্ত কার্যকরী মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। ওপেনারদের ব্যাট ঘোরানোর পরের সময়টা যাঁরা সিঙ্গলসে স্কোরবোর্ড সচল রেখে দিতেন। পরের দিকে ভারতের হয়ে যে কাজটা করতে দেখা গিয়েছে যুবরাজ-কাইফদের। এর ফলে তিনশো রান তোলাটাও ক্রমশ সহজ হয়ে আসে।
কিন্তু সাড়ে তিনশোর উপরে রান তাড়া করা? এই রেওয়াজ কি টি-টোয়েন্টিরই ফসল? যেখানে ছোট করা বাউন্ডারি ঘেরা মাঠে চার-ছয়ই এক এবং একমাত্র নির্ধারক? যেখানে ৫ বলে ২০ রান বাকি থাকলেও টিভিমুখো দর্শক বলে ফেলেন, “ও ঠিক হয়ে যাবে!” এ দিনের ম্যান অব দ্য ম্যাচ রোহিত শর্মা বলছেন, “ওয়ান ডে ক্রিকেটে নতুন নিয়ম (পুরো ৫০ ওভারে চার জনের বেশি প্লেয়ার ৩০ গজি বৃত্তের বাইরে থাকতে পারবে না) যে কোনও রানের লক্ষ্যকেই সহজ করে দিয়েছে।”
রোহিত শর্মার সঙ্গে বাকি যে দুই ভারতীয় ব্যাটসম্যান এ দিন ৩৫৯-কে জলভাত বানিয়ে ছাড়লেন, তাঁরাও টি-টোয়েন্টি যুগের হেভিওয়েট প্রতিভূ! বিরাট কোহলি, শিখর ধবন আইপিএলের এক একটা টিম তাকিয়ে থাকে স্রেফ এঁদের দিকে। বস্তুত, এই তিন জনের মধ্যে দু’জন আবার আইপিএল সিক্সে নিজ-টিমের অধিনায়কও ছিলেন। এবং ওয়ান ডে ক্রিকেটের অদ্ভুত বিবর্তনের উপর কার্যত সিলমোহর প্রতিষ্ঠার দিনে তাঁরা যা যা করে দেখালেন, তাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে শব্দকোষে টান পড়তে পারে। খেলার শেষে কাটাছেঁড়াতেও নায়কদের মুখে সেই টি-২০রই প্রসঙ্গ। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়ক রোহিত শর্মা সম্পর্কে বেঙ্গালুরুর মাথা বিরাট কোহলি বললেন, “রোহিত হল টি-২০ ক্রিকেটের সব চেয়ে বিপজ্জনক প্লেয়ার। ও থাকা মানেই ম্যাচ হাতে থাকা।” কোন ম্যাচ সম্পর্কে বলছেন কোহলি? না, ৫০ ওভারের ম্যাচ সম্পর্কে। তাঁর এই কথা এবং তার আগে ধুন্ধুমার ব্যাটিং থেকেই পরিষ্কার, এ বার থেকে ওয়ান ডে ম্যাচে ছড়ি ঘোরাবেন টি-২০র সেরা ব্যাটসম্যানরাই। কোহলি নিজে কী করলেন? মাত্র ৫২ বলে সেঞ্চুরি! ভারতীয়দের মধ্যে দ্রুততম ওয়ান ডে শতরান। কোহলিকে তেড়ে গালাগাল দিয়েও লাভ হল না অস্ট্রেলিয়ার। উত্তরে যতটা ব্যাট চলল, ঠিক ততটা মুখ! শিখর ধবন নামক এক জাঠ যুবকের ডাকনামটাই বোধহয় আজ থেকে ভারতীয় ক্রিকেটমহলে চালু হয়ে যাওয়া উচিত। গব্বর, গব্বর সিংহ! দিল্লি ক্রিকেটমহলে শিখরকে নিয়ে কম গল্প চালু নেই। প্রবল ঠান্ডায় ঊর্ধ্বাঙ্গে নাকি এক টুকরো সুতোও না চড়িয়ে মাঝে মধ্যেই সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডায় বসে পড়েন শিখর! জিজ্ঞেস করলে নাকি উত্তর দেন, ‘শের কো ঠন্ড নহি লাগতা!’ এবং অবশ্যই রোহিত শর্মা। যিনি বুঝিয়ে দিলেন, তাঁকে নিয়ে নিরন্তর সমালোচনাটা এ বার অন্তত থামা দরকার।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে ম্যাচের পর দেখা গেল, মুখচোখে অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে ঘুরছেন। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে বলেও গেলেন, “আমার দেখা অন্যতম সেরা ম্যাচ। ওয়ান ডে-র ফিল্ডিং নিয়ে কড়াকড়ি, জয়পুরের ভাল পিচের কথা মাথায় রেখেও বলব, ব্যাটসম্যানরা অসাধারণ খেলেছে।” ক্যাপ্টেন বলতেই পারেন। তবে এই জয়ের অন্য দিক, সাম্প্রতিক কালে বোলারদের সবচেয়ে জঘন্য পারফরম্যান্সটা ঢেকে দেওয়া গিয়েছে। এবং পুরোটাই ঘটিয়েছেন ওঁরা তিন জন। ভারতের রান তাড়া করার সর্বোচ্চ রেকর্ডটা ভেঙেছেন (আগে ছিল এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৩৩০), অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তিনশো তাড়া করে হারার ভূতটাও আর নেই।
বছর চারেক আগে হায়দরাবাদে অস্ট্রেলিয়ার সাড়ে তিনশো তাড়া করতে নেমে কানের পাশ ঘেঁষে জয় ছিটকে যায়। মাত্র তিন রানে। এবং এক মহানায়কের ১৭৫ রানের ইনিংসও শেষ পর্যন্ত দেশকে বাঁচাতে পারেনি।
নামটা চাই? খুব সহজ সচিন তেন্ডুলকর!
|
জয়ী |
বিপক্ষ |
লক্ষ্য |
কবে |
দক্ষিণ আফ্রিকা |
অস্ট্রেলিয়া |
৪৩৪ |
মার্চ, ২০০৬ |
ভারত |
অস্ট্রেলিয়া |
৩৫৯ |
১৬ অক্টোবর, ২০১৩ |
নিউজিল্যান্ড |
অস্ট্রেলিয়া |
৩৪৬ |
ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ |
নিউজিল্যান্ড |
অস্ট্রেলিয়া |
৩৩৬ |
ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ |
অস্ট্রেলিয়া |
ইংল্যান্ড |
৩৩৩ |
ফেব্রুয়ারি, ২০১১ |
ভারতের এর আগে সর্বাধিক রান তাড়া করে জয় |
পাকিস্তানের ৩২৯ রানের জবাবে ৩৩০-৪।
মার্চ, ২০১২, শের-ই-বাংলা স্টেডিয়াম (মীরপুর) |
|