প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল এটা বুঝি এক ধরনের ‘খুড়োর কল’। লম্বাটে একটা বাড়ি। মাথায় টিনের চাল। টিনের প্রান্তে লাগানো টিনের ডোঙা। ডোঙার মুখ গিয়ে মিশেছে একটি পাইপে। পাইপ নেমে এসেছে নীচে। পাইপের অন্য মুখ একটি সিমেন্টের বড় কলসির মতো জলাধারের ঢাকনায় ফুটো করে লাগানো কয়েছে। সিমেন্টের বড় কলসির নীচে রয়েছে কল।
ব্যাপারটা কী?
সমাজকর্মী সবুজ জানালেন, আর্সেনিক থেকে বাঁচতে এটা একটা কৌশল। মাটি থেকে আমরা জল তুলছি না বর্ষার সময়ে। বর্ষার জলকে ধরে রেখেই সব কাজ চালাচ্ছি।
সময়টা ছিল ফেব্রুয়ারি মাস। হাতে কলমে ওই প্রযুক্তির কার্যকারিতা দেখাতে সবুজের সহকারীরা পুকুর থেকে বালতি বালতি জল এনে ঢাললেন টিনের চালে। আর তখনই বোঝা গেল ব্যাপারটা। টিনের চালের জল গিয়ে পড়ছে ডোঙায়। ডোঙা থেকে জল গিয়ে পড়ছে পাইপে। পাইপ থেকে জল গিয়ে জমা হচ্ছে সিমেন্টের কলসিতে।
ছবিটা বাংলাদেশের পাবনার একটি গ্রামের। নামটা ভুলে গিয়েছি, এত দিন পরে যে নামটা কাজে লাগবে, সে কথা তখন বুঝিনি। ২০০২ সাল। ঢাকায় আর্সেনিক দূষণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অলোচনাচক্রে গিয়ে বাংলাদেশের নানা আর্সেনিক-পীড়িত এলাকা দেখার সুযোগ হয়েছিল। কী ভাবে গ্রামের মানুষ এই দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করছেন তা দেখতেই গিয়েছিলাম পাবনা। এবং গিয়ে একটা আশ্চর্য ব্যাপার আবিষ্কার করলাম। আর্সেনিক দূষণ আটকাতে গিয়ে গ্রামের মানুষ জল সংরক্ষণের একটা কার্যকর ব্যবস্থাও তৈরি করে ফেলেছেন। সমাজকর্মী সবুজ বললেন সে কথা, “আমরা গ্রামের মানুষকে বলেছি নলকূপের জল যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারা এই প্রযুক্তি নিয়ে এসেছেন। এখন দেখছি জল সংরক্ষণেও এই প্রযুক্তির অবদান রয়েছে।”
তার পর এগারো বছর কেটে গিয়েছে। সবুজদের মুখে শুনেছি পাবনার ওই গণ্ডগ্রামে দেখে আসা প্রযুক্তি এখন বাংলাদেশে গ্রামে গ্রামে ব্যবহার করা হচ্ছে। নকশার অদলবদল হয়েছে। আর্সেনিক দূষণ নয়, মূলত জল সংরক্ষণ করতেই এই প্রযুক্তি এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। পশ্চিমবঙ্গে আমরা এখনও ওই সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখিনি। কী আর্সেনিক নিয়ন্ত্রণে, কী জল সংরক্ষণে। সরকারি স্তরে অনেক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে, কিন্তু শহরাঞ্চলে পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া বৃষ্টির জল ধরে রাখার কোনও ব্যবস্থাই আমরা করতে পারিনি। পুকুর, খাল, বিলে যেটুকু বৃষ্টির জল জমার জমেছে। জল সংরক্ষণ বলতে এটাই একমাত্র কার্যকর প্রযুক্তি পশ্চিমবঙ্গে। |
রাজ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প চালু করেছেন। যাঁরা সংরক্ষণ নিয়ে কাজকর্ম করেন, ভাবেন, তাঁরা ভেবেছিলেন এ বার বুঝি একটা কিছু হবে। কিন্তু বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরে তাঁরা বুঝলেন মুখ্যমন্ত্রীর ওই পরিকল্পনার বাস্তব রূপ হল বেশি করে পুকুর কাটা এবং পুকুর সংরক্ষণ করা। এটাই যে সব জায়গায় জল সংরক্ষণের ভাল উপায়, জলবিজ্ঞানীদের অনেকেই কিন্তু তা মানেন না। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্তার মন্তব্য, “মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, হুগলি ও বর্ধমানের কিছু এলাকায় পুকুর খুঁড়ে বা সংস্কার করে লাভ নিশ্চয়ই রয়েছে। কারণ, সেখানে মাটির খুব কাছাকাছি বালিমাটির স্তর রয়েছে। পুকুরের জল সহজেই সেই বালিমাটির স্তর ভেদ করে চলে যায় মাটির স্তরের মূল জলস্তরে। কিন্তু কলকাতার কাছাকাছি এলাকায় পুকুরের নীচেই রয়েছে কাদামাটি, যা ভেদ করে পুকুরের জল মাটির নীচের পরিষ্কার জলস্তরে পৌঁছতে পারবে না। তাই বৃষ্টির জল ধরে রাখার ক্ষমতা ওই সব এলাকার পুকুরের কম।”
এক জলবিজ্ঞানীর অভিজ্ঞতা, “প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে একটি পুকুরের জল দ্রুত নেমে যাচ্ছে বলে আমরা উৎসাহিত হয়েছিলাম।’ তাঁরা ভেবেছিলেন, জলটা মাটির নীচে গিয়ে জলস্তরকে সমৃদ্ধ করছে। কিন্তু তার পর? ‘গিয়ে দেখলাম ওই পুকুরের আশাপাশে বেশ কয়েকটি বহুতল তৈরি হয়েছে, যারা গভীর নলকূপ চালিয়ে ভূগর্ভের জল তোলে। আমরা বেশ কয়েক দিন সমীক্ষা চালিয়ে দেখলাম যখনই ওই বহুতলগুলি পাম্প চালিয়ে জল তুলছে তখনই পুকুরের জল নেমে যাচ্ছে হু হু করে। জলটা টেনে নিচ্ছে বহুতলগুলি!”
বাংলাদেশ থেকে ফিরে রাজ্যের আমলাদের কাছে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর্সেনিক দূষণ মোকাবিলায় কম খরচার (বাংলাদেশে ১১ বছরের আগেকার হিসেবে ওই ধরনের এক একটি প্রকল্পে খরচ পড়ত বড়জোর আড়াই হাজার টাকা) ওই প্রযুক্তি এ রাজ্যে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ মডেল পছন্দ হয়নি এ রাজ্যের পরিকল্পনা রচয়িতাদের। তখন কেন্দ্রীয় সরকার আর্সেনিক দূষণ মোকাবিলায় বিশাল অঙ্কের টাকার নানা প্রকল্প ঘোষণা করেছে। রাজ্য প্রশাসনের ঝোঁক ছিল সে দিকেই। তার মাসুল এখনও আমরা গুনে যাচ্ছি।
কেন্দ্রীয় সরকার এখন বৃষ্টির জল সংরক্ষণ এবং পুনর্ব্যবহারের নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ওই সব প্রকল্পই ব্যয়বহুল। এখনও পর্যন্ত সেগুলি কার্যকর করতে তেমন পদক্ষেপ করেনি রাজ্য। এমনকী মানুষকে সচেতন করতেও সরকারি তরফে কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। জলবিজ্ঞানীরা অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশ সেই সময় যে ব্যবস্থা নিয়েছিল সেটাই এখন বৃষ্টির জল ধরে রাখতে কাজে দিচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে জল সংরক্ষণে কোনও বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ারই প্রয়োজন হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় সংস্থা ভূ-জল পর্ষদ বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করার যে সব পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে চলেছে সেগুলি প্রধানত শহরগুলিতে কার্যকর করার চেষ্টা হচ্ছে। যেমন ছাদের জল সংরক্ষণ করা এবং খোলা জায়গায় জল জমলে তা ভূগর্ভে ফেরত পাঠানো। রীতিমত ব্যয়বহুল প্রকল্প।
ভূগর্ভে জল ফেরত পাঠানোর ভাল উপায় কী? জলবিজ্ঞানীরা বলছেন, কলকাতায় যে পরিমাণ বৃষ্টি হয় তার শতকরা নব্বই ভাগই গড়িয়ে চলে যায় সমুদ্রে, মাটির নীচে জলের স্তরে পৌঁছতেই পারে না। ওই জলের স্তরটি রয়েছে, এলাকা ভেদে, ৮০ থেকে ২৫০ মিটার নীচে। বৃষ্টির জলকে পাঠিয়ে দিতে হয় সেই স্তরে। পুরনো কুয়ো কিংবা পরিত্যক্ত গভীর নলকূপকে এই কাজে লাগানো যেতে পারে। তা ছাড়া নতুন ভাবে নলকূপ খুঁড়ে বা কুয়ো খুঁড়েও সেটা করা যায়।
রাজ্য প্রশাসনের তরফে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের কাজের দেখভাল করে রাজ্য পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। পর্ষদের হিসেবে, রাজ্যের চারটি জেলায়— বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং দার্জিলিং— ৫০টি স্কুলে এই প্রকল্প কার্যকর করা হয়েছে, কলকাতার তিনটি সহ আরও ৩২ টি স্কুলে এই প্রকল্প রূপায়ণের চেষ্টা হচ্ছে। রাজারহাটে একটি আবাসনেও এই ধরনের একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। কলকাতা পুরসভার সংশোধিত বিল্ডিং রুলে (২০০৯) পরিষ্কার বলা হয়েছে, বাড়ির নকশায় বৃষ্টির জল সংরক্ষণের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা দিতে হবে। না হলে ওই নকশা মঞ্জুর হবে না। কোনও আবাসন কিংবা বাড়ির পরিবর্ধনের অনুমতির সময়েও দিতে হবে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের পরিকল্পনা।
কড়া আইন রয়েছে। কিন্তু তা মানানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। কিন্তু আইন তো আর বৃষ্টির জল ধরতে পারবে না। |