গত দশ বছরে, ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে, পশ্চিমবঙ্গে মোট ৫৩৪টি শহরের জন্ম হয়েছে। নতুন শহরের জন্মের মাপকাঠিতে এই দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশে একেবারে প্রথম স্থানে আছে। ২০১১ সালের জনগণনা থেকে এই তথ্যটি পাওয়া গিয়েছে। অবশ্য, গোটা দেশ জুড়েই নতুন শহরের বিস্ফোরণ হয়েছে। এই দশ বছরে ভারতে আড়াই হাজারেরও বেশি নতুন শহর তৈরি হয়েছে। সংখ্যাটা কত বেশি, সেটা বোঝার জন্য একটা তুলনা করা যাক— ১৯০১ থেকে ২০০১, পুরো একশো বছরে ভারতে আড়াই হাজারের কম নতুন শহর তৈরি হয়েছিল।
প্রশ্ন হল, শহর কাকে বলে? দু’রকম সংজ্ঞা সম্ভব। প্রথমত, কোনও বসতি এলাকায় যদি স্বায়ত্বশাসনের ব্যবস্থা থাকে (যেমন পুরসভা বা পুরনিগম, অথবা প্রজ্ঞাপিত অঞ্চল অথবা ক্যান্টনমেন্ট), তবে তাকে শহর বলা হয়। দ্বিতীয় সংজ্ঞা অনুসারে, কোনও এলাকায় যদি জনসংখ্যা পাঁচ হাজার বা ততোধিক হয়, প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০০ জন মানুষ বাস করেন এবং পুরুষ কর্মীদের অন্তত ৭৫ শতাংশ যদি অ-কৃষি পেশায় নিযুক্ত থাকেন, তবে সেই এলাকাটি শহর হিসেবে নথিভুক্ত হবে। যে অঞ্চলগুলি প্রথম সংজ্ঞা অনুসারে শহরের স্বীকৃতি পায়, সেগুলিকে বলা হয় স্ট্যাটুটারি টাউন। আর, দ্বিতীয় সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত শহরকে বলা হয় সেনসাস টাউন। উল্লেখ করা যাক, শহরের সংজ্ঞা কী হবে, তা প্রতিটি দেশ নিজের মতো করে স্থির করতে পারে। ভারত ছাড়া গোটা দুনিয়ায় আর মাত্র পাঁচটা দেশ আছে, সেখানে শহরের সংজ্ঞায় অধিবাসীদের কাজের চরিত্রও অন্তর্ভুক্ত।
২০১১ সালের জনগণনায় আরও একটি তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এই প্রথম বার ভারতে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গ্রামের হারকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এই তথ্যটির মাহাত্ম্য বুঝতেও একটু প্রেক্ষিত জানা প্রয়োজন। ১৯০১ সালে ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ শহরে বাস করত। ১৯৫১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশে। এখন তা ৩১ শতাংশ। দুনিয়ার বহু দেশের তুলনাতেই সংখ্যাটি নগণ্য। কিন্তু, এতেই ভারতের শহরাঞ্চলে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮ কোটি— ইউরোপের কোনও ছোট দেশে এত সংখ্যক মানুষই নেই। ফলে, সংখ্যাটি হেলাফেলার নয়। তার ওপর, এখন থেকে যদি শহরে গ্রামের তুলনায় বেশি হারে জনসংখ্যা বাড়ে, তবে ভারতের শহুরে জনসংখ্যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হবে বইকী। |
সহাবস্থান। মেচেদার মতো অঞ্চলে একই সঙ্গে গ্রাম ও শহর। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস। |
পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে আসি। স্বাধীনতার সময় নগরায়ণের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশে চতুর্থ স্থানে ছিল। ২০০১ সালে তা সপ্তম স্থানে নেমে এসেছিল। স্বাধীনতার পর থেকে এই রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় বেশি হারে বেড়েছে, কিন্তু শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে জাতীয় গড়ের চেয়ে কম হারে। এর একটা অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নগরায়ণের মূল চালিকাশক্তি ছিল শিল্পায়ন। ঔপনিবেশিক আমলে শিল্পায়নের ফলে দেশের নানা প্রান্ত থেকে শ্রমিকের দল বাংলার শহরাঞ্চলে এসে ভিড় করত। স্বাধীনতার পর সেই ধারা ক্রমে স্তিমিত হয়ে এসেছে। রাজ্যের মধ্যেও এক জেলা থেকে অন্য জেলায় অভিবাসন খুব একটা হয়নি। দেশভাগের ফলে, ১৯৫১ সালের সেনসাসে, শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে ছবি দেখা গিয়েছিল, স্বাভাবিক কারণে সেটাও আর নেই। ফলে, বহু বছর ধরেই পরিসংখ্যান এই রাজ্যের নগরায়ণের একটা ম্লান ছবি তুলে ধরছিল। ২০১১ সালের সেনসাসের যে ফলগুলি ইতিমধ্যেই দেখতে পাওয়া গিয়েছে, তাতে সেই চলতি ছবিতে কিছু ধাক্কা লেগেছে।
এই রাজ্যে নগরায়ণ ঐতিহাসিক কারণেই চূড়ান্ত অসম। ঔপনিবেশিক আমলে আধুনিক নগরায়ণ হয়েছিল কলকাতা বন্দরকে কেন্দ্র করে। চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ও নদিয়াকে নিয়ে যে বৃহত্তর কলকাতা, সেখানে শিল্পায়নের হাত ধরে নগরায়ণ এগিয়েছিল। জন্ম হয়েছিল অনেক ছোটবড় চটকল-শহরের। উত্তরবঙ্গে চা-বাগানকে কেন্দ্র করে কিছু শহর ও শৈলশহর গড়ে উঠেছিল। আসানসোল-রানিগঞ্জে কয়লাখনি-কেন্দ্রিক শহর। বাকি সব জেলাতেই নগরায়ণের মাত্রা খুব কম ছিল। স্বাধীনতার পর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দৌলতে দুর্গাপুর, হলদিয়ার মতো শহর গড়ে উঠেছে। অন্য দিকে, অপরিসীম বৃদ্ধি হয়েছে শিলিগুড়ির। কিন্তু তার বাইরে নগরায়ণের ছবিটা খুব বদলায়নি। ২০১১ সালের জনগণনাতেই প্রথম দেখা গেল, শুধুমাত্র বাঁকুড়া বাদে রাজ্যের আর সব জেলাতেই নগরায়ণের হার দশ শতাংশের বেশি হয়েছে।
প্রশ্ন হল, নগরায়ণের ছবিটাকে আমরা কী ভাবে দেখব? তত্ত্বগত ভাবে একটি দেশ বা অঞ্চলে শহরের কাঠামো হওয়া উচিত পিরামিডের মতো— বড় শহরের সংখ্যা কম হবে, ছোট শহর থাকবে সংখ্যায় অনেক বেশি। আর, সেই ছোট শহরগুলির সম্মিলিত জনসংখ্যাও বড় শহরের তুলনায় ঢের বেশি হবে। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই এর উল্টোটা ঘটে। ভারত, এবং পশ্চিমবঙ্গও, ব্যতিক্রম নয়। গোটা পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে আর একটাও এমন শহর নেই যার জনসংখ্যা কলকাতার জনসংখ্যার দশ শতাংশও ছুঁতে পারে। কলকাতার কারণেই গত ষাট বছরে পশ্চিমবঙ্গের মোট শহরবাসীর অন্তত পঁচাত্তর শতাংশ প্রথম শ্রেণির শহরে (অর্থাৎ যে শহরের জনসংখ্যা কমপক্ষে এক লক্ষ) বাস করেন। ২০১১ সালের সেনসাসেই প্রথম দেখা গেল, চতুর্থ শ্রেণির (জনসংখ্যা দশ থেকে কুড়ি হাজার) এবং বিশেষত পঞ্চম শ্রেণির (জনসংখ্যা পাঁচ থেকে দশ হাজার) শহরে জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। অন্য দিকে, মোট নগরবাসীর মধ্যে প্রথম শ্রেণির শহরের বাসিন্দাদের অনুপাত উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
এখানেই পশ্চিমবঙ্গের ‘সদ্যোজাত’ শহরগুলি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে মাত্র তিনটি নবগঠিত পুরসভা। বাকি সবই সেনসাস টাউন। এবং, এই নতুন শহরগুলি আর কলকাতা-কেন্দ্রিক নয়। সেগুলো ছড়িয়ে আছে গোটা রাজ্য জুড়ে। সবচেয়ে বেশি নতুন শহর তৈরি হয়েছে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, জলপাইগুড়ি এবং পুরুলিয়াতে। এটা পশ্চিমবঙ্গের নগরায়ণের ক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। আরও একটি তথ্য খেয়াল করার মতো— এই নতুন শহরগুলির মাত্র ২৭ শতাংশ কোনও পুরনো বা নতুন শহরাঞ্চলের অংশ।
কীসের ভিত্তিতে এই নগরায়ণের প্রবণতা বাড়ল? এই প্রশ্নের উত্তরে কোনও একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে অঙ্গুলিনির্দেশ করা মুশকিল। কেউ বলছেন, এটা সেনসাস কর্মীদের অত্যুৎসাহের ফল। আপাতত সেই সম্ভাবনাটি যদি সরিয়ে রাখি, তবে কৃষি এবং শিল্পের গল্পে এই প্রশ্নের একটা উত্তর পাওয়া যেতে পারে। সেনসাস টাউন হওয়ার যে তিনটে শর্তের কথা লেখার গোড়ায় উল্লেখ করেছিলাম, তার মধ্যে জনঘনত্বের শর্তটি, ভারতের বিপুল জনসংখ্যার কারণেই, প্রায় সব ক্ষেত্রেই পূর্ণ হয়। ফলে, কোনও একটি জনপদ নগর হিসেবে চিহ্নিত হবে কি না, তা নির্ভর করে পুরুষদের পেশার ওপর— অন্তত ৭৫ শতাংশ পুরুষকে অ-কৃষি পেশায় যুক্ত থাকতেই হবে। এই শর্তটি পূরণ না করতে পারার জন্যই ২০০১ সালের সেনসাসে ক্যানিং বা মহিষাদলের মতো শতাব্দীপ্রাচীন শহর তাদের ‘শহর’ তকমাটি হারিয়েছিল। অনুমান করা চলে, কৃষি যে ভাবে ক্রমেই অ-লাভজনক হয়ে উঠেছে, এবং ক্রমশ অধিকতর সংখ্যায় মানুষ অ-কৃষি পেশা, যেমন ঘরোয়া শিল্পে শ্রমিকের কাজ, বেছে নিচ্ছেন— তাতেই বহু জনপদে অ-কৃষি পেশাভুক্ত পুরুষের সংখ্যা ৭৫ শতাংশ ছাড়াচ্ছে। সর্বভারতীয় প্রেক্ষিত থেকে আর একটা কারণ পাওয়া যাচ্ছে। পরিবেশ-আইনজনিত কারণে শিল্প ক্রমেই গ্রামের দিকে সরে যাচ্ছে। অন্য দিকে, ঘরোয়া শিল্প, মেয়েদের শিল্পও বাড়ছে।
তবে, এই নগরায়ণ নিয়ে দু-একটা শঙ্কার কথাও উল্লেখ করে রাখা ভাল। প্রথম কথা, সেনসাসের হিসেবে ‘শহর’ হলেও এই অঞ্চলগুলি প্রশাসনিক ভাবে গ্রাম— পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অধীন। ফলে, পরিষেবার মান বেশ খারাপ। এই ‘শহর’গুলি যদি যথেচ্ছ ভাবে বাড়তে থাকে, তবে পরিকাঠামো তৈরি করা এবং নাগরিক পরিষেবার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না। অন্য দিকে, এই নগরায়ণ ক্রমে কৃষিজমি, জলাজমি গিলে খাবে। পরিবেশের পক্ষে তা মারাত্মক।
|
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক |