একটা সময় ছিল, যখন শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষে গোটা কলিকাতা শহর, বস্তুত সমগ্র রাজ্যই ভাঙা মেলার রূপ পরিগ্রহ করিত। চারিদিকে ছড়াইয়া থাকা জঞ্জালের স্তূপ, গঙ্গার ঘাটে-ঘাটে ভাসমান প্রতিমার কাঠামো, রাস্তায়-রাস্তায় মণ্ডপ কিংবা আলোকসজ্জার প্রয়োজনে পড়িয়া থাকা কর্তিত গাছের ডালপালা, মণ্ডপের কাঠ-প্লাই-বাঁশের কঙ্কাল। আর উৎসবের দিনগুলিতে তো মাইকের বিকট তর্জনে কান পাতিবার জো থাকিত না। ক্রমে এই সকল প্রশ্নে নাগরিক সচেতনতা বাড়িয়াছে। পরিবেশের ভারসাম্য অটুট রাখিয়া উৎসব উদ্যাপনের প্রয়াসও লক্ষ করা গিয়াছে। এ ব্যাপারে যেমন ব্যক্তিগত ভাবে অনেক নাগরিক এবং বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্যোগী হইয়াছেন, তেমনই সরকারের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং পূজার উদ্যোক্তা ক্লাবগুলিও সচেষ্ট হইয়াছে। এই সবেরই মিলিত ফল হইল দুর্গোৎসবের উত্তরোত্তর পরিবেশবান্ধব হইয়া ওঠা।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাইতেছে, কলিকাতার অন্তত অর্ধশত বারোয়ারি পূজা এবং দমদম ও বিধাননগরীর বেশ কিছু পূজায় পরিবেশবান্ধব অস্থায়ী শৌচাগার বসানো হইয়াছে। সভ্য পশ্চিমি বিশ্বে আকছার পার্কে, মাঠে জনসমাগমের সময় এ ধরনের শৌচাগার ব্যবহৃত হইলেও এ দেশে এমন নজির বিশেষ নাই। আনাড়ি হাতে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনেও গাছের ডাল কিংবা আস্ত একটি গাছকেই মণ্ডপ বা আলোকসজ্জার স্বার্থে কাটিয়া ফেলার প্রবণতাও এখন হ্রাস পাইয়াছে। প্রতিমার রঙে সিসা ও ক্যাডমিয়ামের মতো দূষণকারী রাসায়নিক বর্জিত হইয়াছে। আলোকসজ্জায় এলইডি বাতি এবং সৌর-বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়িয়াছে। প্রতিমা বিসর্জনের পরেই পুর উদ্যোগে ক্রেন দিয়া নদী-তীর পরিচ্ছন্ন করিয়া ফেলা হয়। এগুলি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ঘটনা। সরকার ও তাহার বিভিন্ন সংস্থা এবং নাগরিকদের তরফে এই সচেতনতা, তৎপরতা, শুভবোধ যদি বছরভ’র দেখা যাইত, তবে কলিকাতা এবং এই বঙ্গদেশই তো আরও বাসযোগ্য, সহনীয় একটি জনপদে পরিণত হইত।
তাহার অর্থ এই নয় যে, শারদীয় উৎসবের মরসুমে সব কিছুই আদর্শ হইয়া উঠিয়াছে। ক্লাবকর্তা তথা পূজা-উদ্যোক্তারা যাহাই বলুন, পুলিশ কমিশনারও যতই ঢালাও শংসাপত্র দিন, চলাচলের রাস্তা আটকাইয়া পক্ষ কাল বা তাহারও অধিক সময় ব্যাপিয়া উৎসবের মণ্ডপ, তোরণ, আলোকসজ্জা মোতায়েন রাখা কোনও শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। পথ যে পথিকের ও যানবাহনের, এই সত্য ভুলিয়া না গেলে এই ভাবে পথজোড়া মণ্ডপকে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ কিংবা পুরসভা ছাড়পত্র দিতে পারিত না। একই রকম সমস্যা সৃষ্টি করে বিসর্জনের সময় তারস্বর। কান ঝালাপালা করা ওই শব্দদৈত্যের অত্যাচার বাসিন্দাদের অতিষ্ঠ করিয়া মারে। তাহার সহিত যুক্ত হয় বাজির প্রবল নিনাদ, যাহা চলতি বছরে আরও বাড়িবার আশঙ্কা প্রবল। পাড়ায় থাকিতে হইবে বলিয়া ভয়ে লোকে মুখে কুলুপ আঁটিয়া অত্যাচার সহ্য করে। এই বিষয়গুলির প্রতি এ বার পরিবেশবিদদের নজর দিবার সময় আসিয়াছে। মাটির প্রতিমার পরিবর্তে বহু পরিবেশ-সচেতন পূজা কমিটি এখন কাঠের, পাথরের কিংবা ধাতুর প্রতিমা বানাইতেছেন, যাহা নদীবক্ষে বিসর্জন দিবারও প্রয়োজন নাই। মণ্ডপের আয়তন উচ্চতায় ও আড়ে-বহরে উত্তরোত্তর হ্রস্ব করিয়া আনা এবং শব্দের নির্যাতন হইতে পল্লিবাসীকে রেহাই দিবার দিকটিও পূজা-উদ্যোক্তা এবং নাগরিকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করুক। |