হায় হতভাগ্য ভারতবাসী! তাহাদের শেষ ‘ঈশ্বর’-এর মেয়াদও বড় জোর ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত। ভারতের আকাশ-বাতাসে অনবরত শোকের তারসানাই বাজিতেছে। কেন এই প্রবল শোকোচ্ছ্বাস? সচিন তেন্ডুলকরের অবসর আসলে অকিঞ্চিৎকর, ভারতের দুর্ভাগ্যের কাঞ্চনজঙ্ঘার সম্মুখে নুড়িসদৃশ। এই অপরিমিত বিষাদকে বুঝিতে হইলে প্রশ্ন করিতে হইবে, কেন সচিন তেন্ডুলকরকে জাতির শ্রেষ্ঠ নায়কের শিরোপা দেওয়াই ভারতের নিয়তি হইল? তাঁহার দক্ষতা লইয়া প্রশ্ন নাই। কিন্তু সেই দক্ষতা একটি খেলার মাঠে মাত্র, তাহাও এমন এক খেলা, আন্তর্জাতিক মানচিত্রে যাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া ভার। ক্রিকেট নামক খেলাটি ভারতীয় উপমহাদেশের বাহিরে গৌরবহীন, নগণ্য। কিন্তু যে খেলাগুলি প্রকৃতার্থেই আন্তর্জাতিক, যেমন টেনিস বা ফুটবল, সেই খেলার সেরা খেলোয়াড়রাই কি তাঁহাদের দেশে ‘জাতির ঈশ্বর’-এর স্বীকৃতি পান? রাফায়েল নাদাল বা লিয়োনেল মেসিকে লইয়া তাঁহাদের ভক্তদের উচ্ছ্বাস আছে ঠিকই, কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস খেলার মাঠের গণ্ডি অতিক্রম করে না। তাহাই বিধেয়, তাহাই যথার্থ। ভারত ব্যতিক্রম। সচিন তেন্ডুলকর ব্যতিক্রম। তাহার কারণ— যাহাকে দেখাইয়া বিশ্বের সম্মুখে বুক ফুলাইয়া দাঁড়ানো চলে, এমন ভারতবাসী আর নাই। যে ক্ষেত্রগুলি প্রকৃত গৌরবের, ভারত সেখানে প্রতিনিধিহীন। ফলে, ক্রীড়াক্ষেত্রের এক নায়ককেই আঁকড়াইয়া ধরিতে হয়।
সচিন তেন্ডুলকর যখন তাঁহার অবসরগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিলেন, সেই সপ্তাহেই সুইডেনের স্টকহল্ম হইতে একটি বাৎসরিক তালিকা প্রকাশিত হইয়াছিল। ২০১৩ সালের নোবেল পুরস্কারজয়ীদের তালিকা। সেই তালিকায় শেষ বার এক ভারতীয়র নাম ছিল গত সহস্রাব্দে। ১৯৯৮ সালে। কেন ১৩০ কোটি মানুষের এই দেশ হইতে এমন এক জনকেও পাওয়া যায় না যিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিরোপাটি জিতিয়া লইতে পারেন— এই প্রশ্ন ভারতীয়দের বিব্রত করে না। কোনও ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মঞ্চে ঠাঁই পায় না। ভারতে কোনও বিশ্বমানের গবেষণা হয় না— উদ্ভাবনীশক্তি ভারত ছাড়িয়াছে। অথচ, যে দেশগুলি মাত্র অর্ধশতক পূর্বেও ভারত অপেক্ষা বহু নিম্নস্তরে ছিল, তাহারা ক্রমে বিশ্বমানের হইয়া উঠিয়াছে। চিনের উদাহরণ স্মর্তব্য। ভারত চিনকে ‘নকলনবিশ’ বলিয়া যতই উপেক্ষা করুক, মৌলিক বিজ্ঞানে চিন ভারতকে ছাড়াইয়া অনেক দূর আগাইয়া গিয়াছে। ভারত পারে নাই। কেন, তাহা ভিন্ন আলোচনা। রাষ্ট্রের দায় অবশ্যই আছে, কিন্তু তাহাই একমাত্র নহে। শিল্প, সাহিত্যের ন্যায় ক্ষেত্রেও তো ভারতে মধ্যমেধারই রাজত্ব। জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনটিতে কোনও ভারতীয়কে দেখা যায় না। অদূর ভবিষ্যতে যাইবে, সেই সম্ভাবনাও অতি সামান্য। অগত্যা সচিন তেন্ডুলকরই ভরসা।
অথচ, এই ভারতেরই এক রাজনীতিকের জীবন হইতে একদা অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন মার্টিন লুথার কিং হইতে আন সাং সু চি; এক পদার্থবিজ্ঞানী এই বৎসরের নোবেলজয়ীর গবেষণার ভিত রচনা করিয়া দিয়াছিলেন; এক চলচ্চিত্রকারকে গোটা দুনিয়া ‘মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ আখ্যানকার’ হিসাবে মানিয়া লইয়াছিল; এক অর্থনীতিবিদ মানব উন্নয়ন মাপিবার সূচক স্থির করিয়া দিয়াছিলেন; এক প্রযুক্তিবিদ বদলাইয়া দিয়াছিলেন শ্রবণের অভিজ্ঞতা। তাঁহারা নায়ক। তাঁহারা নরোত্তম। কারণ, তাঁহাদের কৃতিত্ব বিনোদনের পরিসরে নহে— তাঁহারা বুদ্ধির জগতে, মেধার দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করিয়াছিলেন। ভারতের সন্তানদের মেধায় টান পড়িয়াছে, এমন নহে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র তাহাদের অসাধারণ হইয়া উঠিবার সুযোগ দেয় নাই। অগত্যা সচিন তেন্ডুলকরই এই জাতির শ্রেষ্ঠ প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হইবেন। তাঁহার বিদায়ে ভারত আকুল হইয়া কাঁদিবে। কেন ভারতের কোনও প্রকৃত নায়ক নাই, সেই শোকে কি এক বিন্দু অশ্রুও ব্যয়িত হইবে? |