কোথাও ফলের রস, কোথাও সাজানো মাটির ঘট বা ফুলের টব। এই সব আপাত নিরীহ জিনিসের আড়ালেই দেদার গাঁজা বিক্রি হচ্ছে আসানসোলে খনি ও শিল্পাঞ্চলে।
পুলিশ বলছে, গাঁজা ধরতে মাঝে-মধ্যেই অভিযান চালানো হচ্ছে। ব্যবসায় জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েক জনকে চিহ্নিত করে গ্রেফতারও করা হচ্ছে। কিন্তু কারবার বন্ধ হচ্ছে না। বরং ধৃতেরা ছাড়া পাওয়ার পরে যথারীতি কারবার বাড়াচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, রানিগঞ্জের জে কে নগর এই শিল্পাঞ্চলে গাঁজার সব চেয়ে বড় পাইকারি বাজার। সেখানকার ১৬টি দোকান থেকে নানা এলাকায় বিক্রির জন্য গাঁজা নিয়ে যায় কারবারিরা। সম্প্রতি ওই বাজারে হানা দিয়ে পুলিশ ২২ কেজি গাঁজা উদ্ধার করে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ এক ব্যক্তি ও তার ছেলেকে গ্রেফতার করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন বিক্রেতা জানাচ্ছে, গত ৩০ বছর ধরে মনিপুর থেকে গাঁজা আসা বন্ধ। গুণগত মানে সেই গাঁজা ছিল আকর্ষণীয়। এখন বেশির ভাগ গাঁজা আসছে বিহার থেকে। তার পর তা সাড়ে চার হাজার টাকা কেজি দরে আসে জে কে নগর বাজারে। আসানসোল দক্ষিণ ও উত্তর থানা, জামুড়িয়ার শ্রীপুর ও নিঘা এলাকার বিক্রেতারা ওই গাঁজা কিনে নিয়ে যায়। খোলা বাজারে ১ ভরি বা ১০ গ্রাম গাঁজা ১২০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসেবে এক কেজির দাম নিদেনপক্ষে বারো হাজার দাঁড়াচ্ছে।
শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দাদের বড় অংশের দাবি, নিচুতলার কিছু পুলিশকর্মীর সঙ্গে কারবারিদের সুসম্পর্ক রয়েছে। তাদের মদতেই দিন-দিন কারবারির সংখ্যা বাড়ছে। যদিও আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের কর্তারা তা উড়িয়ে দিয়েছেন। আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের এডিসিপি (সেন্ট্রাল) সুরেশকুমার চাডিয়া বলেন, “এ রকম খবর আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা এ নিয়ে অভিযানে নামব। উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কোথায়-কোথায় হাতে-গরম পাওয়া যাচ্ছে গাঁজা?
স্থানীয় সূত্রের দাবি, আসানসোল বিশেষ সংশোধনাগারের মূল দরজার ঠিক উল্টো দিকে ট্রান্সফর্মারের পাশে পান, সিগারেট, চকোলেটের দোকানে বিক্রি হচ্ছে গাঁজা। সেখান থেকে সোজা পথে পৌঁছে যাচ্ছে কয়েদিদের কাছেও। পুরনো জি টি রোড ধরে আসানসোল দক্ষিণ পুলিশ ফাঁড়ি যেতে বাঁক নেওয়ার সময়ে পাশের একটি গুমটি থেকেও চা-বিড়ির সঙ্গে গাঁজা পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতার হাতে। আসানসোল কুমারপুরে সিনেমা হলের কাছেই রাস্তার ধারে গুমটির মধ্যে যানবাহনের যন্ত্রপাতি সাজানো। সেখানে গিয়ে গাঁজা চাইলেই পিছনের একটি বাড়ি থেকে কারবারি বেরিয়ে এসে পুরিয়া ধরিয়ে দিচ্ছেন হাতে।
আরও আছে। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, বার্নপুর রোডের স্কব গেটের সামনে একটি খৈনির গুমটিতে চলছে গাঁজার কারবার। ওই রাস্তাতেই বিগ বাজারের উল্টো দিকের গলিতে একটি দোকানে, সব্জির দোকানে, বার্নপুর ব্যাঙ্ক রোডে একটি গুমটিতে, আপার রোডে একটি বন্ধ গুমটির পিছনে, বার্নপুর স্টেশন রোডে বাবা মোড়ে বাঁশ দিয়ে বাঁধা একটি গদিতে, ত্রিবেণী মোড়ে একটি গুমটিতে, নরসিংহ বাঁধে একটি ঘর থেকে সরাসরি চলছে এই কারবার।
আসানসোলের বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, রামকৃষ্ণ লেনে একটি গলির গুমটিতে, চক্রবর্তী লেনে একটি বাড়ি থেকে, আসানসোল গ্রামে বড় দুর্গামন্দিরের পাশে একটি চপ-শিঙাড়ার দোকানে, ঊষাগ্রামে একটি গ্যারাজের পাশের গুমটিতে সিগারেট-চকোলেটের সঙ্গে, মহীশিলা বটতলায় একটি ঘরে চলছে গাঁজার ব্যবসা। নিউ ঘুষিকে একটি দোকানে সাজানো ফলের রস। তার আড়ালে মিলছে গাঁজা। ইসমাইল দুর্গামন্দিরের কাছে এক জন বিকেল ৪টে থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত গাঁজা বিক্রি করে।
জামুড়িয়ার বাসিন্দাদের সূত্রে খবর, শহরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পাশে একটি পানের দোকানে, জামুড়িয়ার ১১ নম্বর কালীমন্দিরের পাশে দু’টি গুমটিতে, বোরিংডাঙায় জামুড়িয়া থানার অদূরে একটি পান-গুমটি, হেভিমোড়ে দু’টি দোকানে, নিঘা মোড়ে একটি পান দোকানে, শ্রীপুর পাওয়ার হাউস এসিপি গ্রাউন্ডে একটি অবৈধ মদের দোকানে। জামুড়িয়া ৬ নম্বর ও সিয়া মোড়ে একটি করে গুমটিতে গাঁজা মিলছে। এবিপিট শিবমন্দির এবং সিআইএসএফ ক্যাম্পের সামনে মোট দু’টি বাড়ি থেকে চলছে এই কারবার। খাসকেন্দা মাঠের পাশে একটি চায়ের দোকানে, নিউ কেন্দা ৩ নম্বরে একটি ঘরে এবং হনুমান মন্দিরের পিছনে কাহারপাড়ায় একটি ঘরে, তপসী রেল গেটের পাশে একটি পানের দোকানে, গাইঘাটার পেট্রোল পাম্পের পাশে একটি হোটেলেও চলছে গাঁজা পাচারের ব্যবসা চলছে।
স্থানীয় সূত্রের দাবি, অন্ডালের বহুলামতি বাজার ও শঙ্করপুরে একটি করে দোকানে, অন্ডাল থানা রোডে দু’টি দোকানে এই কারবার বহু দিনের পুরনো। কুলটির ডিসেরগড় নদীঘাটে একটি দোকানে, সাঁকতোড়িয়া বাজারে একটি পুরনো বাড়িতে, বার্নপুরের স্কব গেট লাগোয়া একটি গুমটিতে, বারাবনির লালগঞ্জে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পাশে একটি পান-চায়ের গুমটিতে, দোমহানি আরপিএপ কোয়াটারের পাশে একটি ঘর থেকে গাঁজার কারবার চলছে। এ ছাড়াও শিল্পাঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আরও শ’খানেক দোকান।
পুলিশ কি দেখেও দেখছে না? শিল্পাঞ্চলের মানুষের কাছে প্রশ্ন এখন এটাই। |