|
|
|
|
উৎসব মিটতেই দুর্যোগে নাকাল দুই মেদিনীপুর |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
ক’দিন টানা বৃষ্টি। তার উপরে জলাধার থেকে জল ছেড়েই চলেছে। সব মিলিয়ে ফের জলমগ্ন হয়ে পড়ল পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। বাঁকুড়ার মুকুটমনিপুর জলাধার থেকে জল ছাড়ার ফলে ঘাটাল মহকুমার শতাধিক গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। সুবর্ণরেখার গালুডি থেকে জল ছাড়ায় জলমগ্ন হয়েছে নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর ও দাঁতনের বহু গ্রাম। গত দু’তিন দিনে মোট পাঁচ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। রবিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় গাছ চাপা পড়ে চন্দ্রকোনা ১ ব্লকের জাড়া পঞ্চায়েতের মাধবপুরের সুকুমার ঘোষ (৬০) মারা যান। রবিবারই বাড়ির দেওয়াল চাপা পড়ে বিনপুর ১ ব্লকের নেপুরা এলাকার পল্টু রাউত (৬০) ও রবি লোহার (৪৬) নামে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার রাস্তা পেরনোর সময় জলে ভেসে গিয়েছিলেন গোপীবল্লভপুর ১ ব্লকের অমরদা পঞ্চায়েতের মন্টু পাত্র (৩২)। মঙ্গলবার তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া দাঁতনের মির্জাপুরের অজিত সরেনের (৫৫) দেহ উদ্ধার হয় বাঁশ ঝাড় থেকে। এ দিকে, পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় রানিহাটির কাছে ফের কাঁসাইয়ের বাঁধ ভেঙে জলমগ্ন হয়েছে আশপাশের এলাকা। তবে সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমের তুলনায় পূর্বের পরিস্থিতি অনুকূল। |
|
পাঁশকুড়ার রানিহাটির কাছে কাঁসাইয়ের বাঁধ ভাঙায় জল ঢুকছে গ্রামে। |
প্রশাসন সূত্রে খবর, ডিভিসি জল ছাড়ায় রূপনারায়ণ ফুঁসছে। কংসাবতী, শিলাবতী নদীর জল স্বাভাবিক ভাবে রূপনারায়ণে গিয়ে মেশে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রূপনারায়ণের সঙ্গে এই সমস্ত নদীর জলস্তর বাড়ছে। তার উপরে জল ছেড়েছে মুকুটমণিপুর। ফলে কেঠে হয়ে শিলাবতীতে উপচে পড়ছে জল। মঙ্গলবারও গালুডি এবং কংসাবতী থেকে জল ছাড়ায় জেলার অন্য নদীর জলস্তর বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারি অবশ্য বলেন, “উদ্বেগের কিছু নেই। জলাধারের ছাড়া জলে বেশ কয়েকটি এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। সব এলাকা থেকেই জল নামতে শুরু করেছে। নতুন করে বৃষ্টি হয়নি। পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। পুরো পরিস্থিতির উপর নজর রাখা হয়েছে।” গত রবিবার সকালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। এর প্রভাবে সদর ব্লক এবং কেশপুরের বেশ কয়েকটি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সদরের চাঁদাবিলা, দেউলডাঙা প্রভৃতি এলাকায় শতাধিক বাড়ি ভাঙে। সেই শুরু। তারপর থেকে দুর্যোগ চলছেই। পরিস্থিতি আরও জটিল হয় জলাধারের ছাড়া জলে। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, সোমবার গালুডি থেকে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়। কংসাবতী থেকে ৫৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়। এই জল পৌঁছনোর পর নদী ছাপিয়ে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব মিলিয়ে ৬২টি ত্রাণ শিবির খুলতে হয়। ২ হাজার ৩২৭টি গ্রাম কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১০ হাজার ১৫৩টি বাড়ি সম্পূর্ণ এবং ২২ হাজার ৫২টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রবিবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৪৩.৩৫ মিলিমিটার। সোমবার বৃষ্টি হয় ৪৬.৮৮ মিলিমিটার। জলের স্রোতে কয়েকটি ‘এক্স জমিদারি বাঁধে’ ধস নেমেছে। যে কোনও সময় বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। |
|
|
জলমগ্ন মনসাতলা চাতালে ঝুঁকির যাতায়াত। |
দাঁতনের বালিডাংরি গ্রামে ভরসা সেই নৌকা। |
|
মঙ্গলবার জেলার কিছু দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়। জেলা পরিষদের সেচ কর্মাধ্যক্ষ নির্মল ঘোষও ডেবরার কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেন। ইতিমধ্যে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রাথমিক একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছেন তিনি। সেচ কর্মাধ্যক্ষ বলেন, “জেলার কোথাও বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আমরা সার্বিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেছি। কিছু বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।” এ দিকে, কিছু এলাকা থেকে ত্রাণ বিলি নিয়েও অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। কেশপুরের বিধায়ক রামেশ্বর দোলুই বলেন, “প্রচুর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অথচ, এলাকায় নামমাত্র ত্রাণ পৌঁছচ্ছে।” সবংয়ের বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “এই পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা উচিত।” মঙ্গলবার সকালে মেদিনীপুর সদর ব্লকের পালজাগুলে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। একটি নৌকায় করে এলাকার ১৫-১৬ জন পানীয় জল আনতে গিয়েছিলেন। কয়েকজন কিশোরও ছিল। জল নিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনা ঘটে। কংসাবতী দিয়ে তখন হু হু করে জল বইছে। জলের তোড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আচমকা নৌকাটি উল্টে যায়। শুরুতে চার জন নিখোঁজ ছিলেন। পরে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। জেলাশাসকের নির্দেশে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এলাকায় যান মহকুমাশাসক (সদর) অমিতাভ দত্ত। আপাতত, ওই এলাকার সমস্ত ফেরিঘাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহাতাবনগর, চকদৌলত সহ সদর ব্লকের কয়েকটি এলাকায় বাঁধ ভেঙেছে।
জলের চাপে মঙ্গলবার সকালে দাসপুরের নিজ নাড়াজোল পঞ্চায়েতের বালিপোতা গ্রামে কংসাবতী নদীর বাঁধ ভেঙে নাড়াজোল ও রাজনগর পঞ্চায়েতের প্রায় ২৫-৩০টি গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়ে। প্রশাসনের দাবি, খবর পাওয়া মাত্রই সেচ দফতর, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর-সহ স্থানীয় পঞ্চায়েতের তরফে দুর্গতদের উদ্ধার করে বালিপোতা প্রাথমিক স্কুলে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষ প্রশাসনের ভূমিকায় মোটেই খুশি নয়। বালিপোতার মাঝপাড়ার লক্ষ্মী দোলই, সামাটের পুতুল সামন্ত বলেন, “সকাল থেকে প্রশাসনের কারও দেখা নেই। বাড়ি থেকে যা বের করতে পেরেছি, তা নিয়ে উঁচু রাস্তাতে এসে উঠেছি।” |
|
|
মেদিনীপুরে
জলবন্দি পাম্পহাউস। |
মেদিনীপুর সদর ব্লকের জাগুল
গ্রামে জলমগ্ন স্কুল। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
|
ঘাটাল-চন্দ্রকোনা ও ঘাটাল-মেদিনীপুর (ভায়া নাড়াজোল) সড়ক জলের তলায় চলে যাওয়ায় ফের ঘাটাল মহকুমায় সড়ক পথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নৌকাই ভরসা এখন। ঘাটালের মহকুমাশাসক অদীপ রায় বলেন, “মাইকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। দাসপুর ও ঘাটাল ব্লকে মোট দশটি ফ্লাড শেল্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘাটালের শিলাবতী, কংসাবতী, ঝুমি, কেঠে-সহ সমস্ত নদীর জলই বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। তবে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলে এবং জলাধার থেকে জল না ছাড়া হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।” ঘাটালের উপপুরপ্রধান উদয়শঙ্কর সিংহরায় বলেন, “পুরসভার ১২টি ওয়ার্ডে মঙ্গলবার সকাল থেকেই জল বাড়ছে। এখনও পযর্ন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে পুরসভার তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে নৌকা।
সোমবার সকালে দাঁতন ব্লকের সুবর্ণরেখা নদী ঘেঁষা আলিকষা, তররুই, দাঁতন-২, আঙ্গুয়া, চকইসমাইলপুর পঞ্চায়েতের বহু গ্রামে হু হু করে জল ঢুকে পড়ে। জল ঢোকে ব্লকের পুন্দড়া, সিংদা, পানশোলা, কাঁটাপাল, মুকুন্দপুর, বড়া, কোটপাদা, নীলপুরা, বড়বাঘরা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায়। ইতিমধ্যেই বন্যায় ঘরছাড়া হয়েছেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। ভেঙে গিয়েছে তাঁদের ঘরবাড়ি। এ ছাড়াও চাষের জমি, বাড়ির একাংশ ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৬ হাজার পরিবার। ঘরছাড়াদের আশ্রয় দিতে ৩৭টি ক্যাম্প খুলেছে প্রশাসন। দাঁতনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তররুই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান প্রতুল দাস বলেন, “২০০৮ সালের পর এরকমটা আর হয়নি। আমার পঞ্চায়েতের প্রায় বারোশো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।” |
|
বাঁধের অবস্থা পরিদর্শন করছেন মহকুমাশাসক। মেদিনীপুর সদর ব্লকের পালজাগুল গ্রামে। |
শুধু দাঁতন নয়, সুবর্ণরেখার জলে প্লাবিত হয়েছে কেশিয়াড়ি ব্লকের বাঘাস্তি ও নছিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কিছু এলাকা। কুলবনি, ঝাড়েশ্বরপুর, বালিধাওড়া, ইন্দ্রা, পানসগঞ্জ-সহ প্রায় ১৪টি গ্রামের বন্যা কবলিত মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্লক প্রশাসনের তরফে ১১টি শিবির খোলা হয়েছে। ওই শিবিরগুলিতে প্রায় ৮ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বিডিও অসীমকুমার নিয়োগী বলেন, “আমরা নৌকোয় করে খাবার পৌঁছে দিচ্ছি। পঞ্চায়েতগুলিও আমাদের সাহায্য করছে।” এ দিনই সবংয়েও অতিবৃষ্টিতে বিষ্ণুপুর পঞ্চায়েতের লোকপীঠ ও শালমারা গ্রামে ক্ষতি হয়েছে শ’তিনেক বাড়ির। এর মধ্যে ১০টি পরিবারকে লোকপীঠ প্রাইমারি স্কুলে ও ৮টি পরিবারকে শালমারা প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
এ দিকে, নবমীর সকালে কয়েক সেকেন্ডের ঝড়ে চন্দ্রকোনা-১ ব্লকের জাড়া ও মাংরুল পঞ্চায়েতের মাধবপুর, খিরা, রানিগঞ্জ, তাতারপুর ও শোলা গ্রামের বেশিরভাগ এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। মহকুমাশাসক অদীপ রায় বলেন, “ঝড়ে প্রায় দেড়শোটি বাড়ি সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রায় আড়াইশোটি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সভাধিপতি উত্তরা সিংহ জানান, ওই দিনই গৃহহীনদের জন্য একাধিক শিবির খুলে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারই সঙ্গে ত্রিপল দিয়ে বাড়ি সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে।
পাঁশকুড়া পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের রানিহাটির কাছে গত ২৪ অগস্ট নদীবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। মেরামতির কাজ চলাকালীন মঙ্গলবার দুপুরে ওই বাঁধ ফের ভেঙে যায়। পূর্ত বিভাগের নির্বাহী বাস্তুকার অনির্বাণ ভট্টাচার্য জানান, ৩০ মিটার বাঁধ ভেঙেছে। এর ফলে পাঁশকুড়া পুরসভার ৫টি ওয়ার্ড-সহ প্রতাপপুর, পুরুষোত্তমপুর, রাধাবল্লভচক প্রভৃতি এলাকায় জল ঢুকে পড়ে। অতিরিক্ত জেলাশাসক সাগর সিংহ জানান, প্রতাপপুর সংলগ্ন তমলুক ব্লকেরও বেশ কিছু এলাকায় জল ঢোকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ দিন প্রতাপপুরের কাছে তমলুক-পাঁশকুড়া রাজ্য সড়কে জল দাঁড়িয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিকেলে পাঁশকুড়া ব্লক অফিসে সর্বদল বৈঠক হয়। |
—নিজস্ব চিত্র। |
|
|
|
|
|