আশঙ্কা ছিলই। তাকে সত্যি প্রমাণিত করে পুজোর মধ্যেই ঝড়-বৃষ্টিতে নাকাল হল বর্ধমানবাসী। কোথাও বিজয়া দশমীর রাত কাটল বাঁধের পাহারায়।
পূর্বস্থলী, কেতুগ্রাম, আউশগ্রাম- সহ জেলার বেশিরভাগ ব্লকেই কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “১৩ তারিখের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আউশগ্রাম ১, ২, কেতুগ্রাম ১ ও কাঁকসায় ২০০টির মতো কাঁচা বাড়ি প্রচণ্ড ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।”
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার (নবমী) দুপুরের আচমকা ঝড়ে কেতুগ্রামের বেরুগ্রামে ২৬টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অনেক বাড়ির খড়ের চাল উড়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলিকে আপাতত স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এলাকায় যান স্থানীয় বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজ। কেতুগ্রাম থানার পক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলিকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা জয়ন্ত ঘোষ, স্বপন ঘোষেরা জানান, দিব্যি রোদ ছিল। হঠাৎ করেই আকাশ কালো করে আসে। ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামবাসী ঝর্ণা মাঝি বলেন, “ধার দেনা করে ছেলেমেয়ের জন্য পোশাক কিনেছিলাম। ঝড়ে সব উড়িয়ে নিয়ে গেল।” সোমবার (দশমী) ঝাড়খণ্ডের হিংলো বাঁধ থেকে জল ছাড়ার পরেই কেতুগ্রামের রসুইগ্রামের বাসিন্দারা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশায় রাত জেগে বাঁধ পাহারা দেন। |
আউশগ্রামের দুটি ব্লকেই ভেঙে পড়েছে অনেকগুলো কাঁচাবাড়ি। রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ এ দিন আউশগ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, “আউশগ্রামের ১ ও ২ ব্লকের ১৬০টি বাড়ি ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়েছে। অসংখ্য বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়েছে। প্রায় হাজার মানুষ গৃহহীন। তাঁদের তিনটি শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানীয় জল ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
নবমীর সন্ধ্যার ঝড়ে পূর্বস্থলী ২ ব্লকের কালেখাঁতলা ১ ও নিমদহ পঞ্চায়েতের জামালপুর, নন্দীপাড়া, দোমাড়, ধরমপুর, ও ছাতনি গ্রামের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রায় ৫০টি বাড়ি। এর মধ্যে ২১টি বাড়ি পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সোমবার, দশমীর দিন ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামগুলি ঘুরে দেখেন পূর্বস্থলী ২ ব্লকের বিডিও মোদাস্সার মোল্লা ও পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রায় ৫৬টি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে ত্রাণ দেওয়া চলছে। মঙ্গলবার তপনবাবু বলেন, “ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলিকে ২৪ কেজি করে চাল, ত্রিপল ও জামাকাপড় দেওয়া হয়েছে।” এ দিন পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়া ও বাড়ি তৈরির উপাদান কিনে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য রাজ্যের থেকে ১ কোটি ১২ লক্ষ টাকা অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। জেলা কৃষি দফতর সূত্রে খবর, ঝড়-বৃষ্টিতে চাষেরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। আউশগ্রাম ১, ২, কেতুগ্রাম ১ ও কাঁকসা ও পূর্বস্থলী থানা এলাকার প্রায় ২,৫০০ হাজার হেক্টর ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই পাকা আমন ধান। এছাড়া কলাবাগান ও সব্জি ক্ষেতেরও ক্ষতি হয়েছে।
প্রবল বৃষ্টিতে একটি মাটির বাড়ির দেওয়াল চাপা পড়ে কাঁকসার ঘুটগড়িয়ায় মৃত্যু হয়েছে এক বৃদ্ধের। ভৈরবচন্দ্র দাস (৭০) নামে ওই বৃদ্ধ মন্দিরে যাচ্ছিলেন। তখনই গ্রামেরই এক বাড়ির দেওয়াল ভেঙে পড়ে তাঁর উপর। কাঁকসার বসুধা গ্রামেও কয়েক মিনিটের প্রবল ঝড়ে বেশ কিছু বাড়ি ভেঙে পড়ে। স্থানীয়রা জানান, ঘরের চাল উড়ে, মাটির বাড়ি ধসে জখম হন জনা ১২ বাসিন্দা। গাছ পড়ে একাধিক জায়গায় বিদ্যুতের তারও ছিঁড়ে যায়। প্রশাসন সূত্রে খবর, প্রায় ৭০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। মারা গিয়েছে বেশ কিছু গবাদি পশু। জেলা পুলিশ সুপার এসএমএইচ মির্জা জানান, পুলিশের পক্ষ থেকে ছ’বস্তা চাল, এক ক্যুইন্টাল চিড়ে, দু টিন গুড়, চল্লিশটি ত্রিপল ইত্যাদি ত্রাণ পাঠানো হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্রামে দুর্গতদের রান্না করা খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। জামাকাপড়, কম্বলও দেওয়া হয়েছে। সোমবার গ্রামে গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে এসেছেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। প্লাবিত হয়েছে কাঁকসার সিলামপুর এলাকার কিছু অংশ ও সীতারামপুর মানা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ’দুয়েক পরিবার। দুর্গাপুর পুরসভার পক্ষ থেকে মেয়র পারিষদ প্রভাত চট্টোপাধ্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করেন। মেয়র অপূর্ব মুখোপাধ্যায় জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির হাতে ত্রিপল তুলে দেওয়া হয়েছে। সিলামপুর এলাকায় দামোদরের জলে প্রায় ৩০টি বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। তাঁদের স্থানীয় একটি প্রাথমিক স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন। ত্রাণ সামগ্রীও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
তবে আচমকা ডিভিসি-র জল ছাড়ার প্রতিবাদ জানিয়ে তৃণমূলের পক্ষ থেকে দুর্গাপুরের ডিভিসি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয় এ দিন। তৃণমূল নেতা প্রভাত চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “আগাম না জানিয়ে ডিভিসি জল ছেড়েছে। ফলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। বিপাকে পড়েছেন শ’দুয়েক পরিবার। এর দায় ডিভিসি কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে।” ডিভিসির এক আধিকারিক জানিয়েছেন, বিষয়টি তাঁরা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। |