বারান্দা থেকে সটান
ঝাঁপ, ফুঁসছে মন্দাকিনী
নাম মনে নেই। ছেলেটার মুখটা শুধু চোখে ভাসছে। আধো অন্ধকার ঘরটায় ডাক্তারবাবু একবার ছাদের দিকে চাইলেন। তার পরে সিঁটিয়ে থাকা স্ত্রী ও মেয়ের মুখটা দেখার চেষ্টা করলেন।
তখনই মনে পড়ল ছেলেটার কথা। হেপাটিক কোমায় আচ্ছন্ন অবস্থায় পিজি-তে ভর্তি হয়েছিল। অগ্রজপ্রতিম সহকর্মী আশিস সেনগুপ্তের অবস্থাও হুবহু এক। কারওরই রাত কাটবে বলে মনে হচ্ছিল না। আশিসদা নিভে গেলেন। দু’দিন বাদে ছেলেটা কিন্তু উঠে বসল।
ঘটনাটা অলৌকিক মনে হয়েছিল তখন। এখন নিজের ঘাড়ের কাছে মৃত্যুর ঠান্ডা নিঃশ্বাসের পরে এই জীবনটাও অলৌকিক মনে হয় শ্যামল কর্মকারের। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের দোতলার ঘরে মন্দাকিনী ছলকে ওঠার মুহূর্তটা ভাবলে শরীর অসাড় হয়ে আসে। গৌরীকুণ্ডের সেই রাতটা সত্যি, না এই কলকাতা, আজও গুলিয়ে যায়।
মেঝেটা দুলছে। কে যেন বলছিল, ভাগো ভাগো...জান লে কর কুঁদো! এ-ঘর, ও-ঘর দালান পেরিয়ে প্রাণ নিয়ে সপরিবার দৌড় আর একবস্ত্রে বারান্দা থেকে ঝাঁপ। হাত-পা ভাঙলে, ভাঙুক। শুধু বেঁচে থাকি!
ডিএল খান রোডে সরকারি আবাসনে পুজোর জোগাড়ে ব্যস্ত স্ত্রী প্রতিমা। পঞ্চমীর সন্ধেয় গিন্নিদের রান্নার হাট বসেছিল। প্রতিমা পোলাও রাঁধলেন সারা দুপুর। ম-ম সুবাস! মুম্বই থেকে ছেলে এসেছে। পুজোসংখ্যায় মুখ গুঁজে কলেজপড়ুয়া কন্যা মুনিয়া।
শাঁখের আওয়াজটা ফের মন্দাকিনীর গর্জন হয়ে ওঠে।
স্বামী জগদীশানন্দের কথা মনে পড়ে যায়। ভারত সেবাশ্রমের পাঁচতলায় নদীর দিকের ঘরে ঢুকে উনিই তো বলেছিলেন, “মন্দাকিনীর এমন বিধ্বংসী রূপ কখনও দেখিনি! আপনারা বরং দোতলায় ও পাশের ঘরটায় যান!” এর কয়েক মুহূর্ত বাদেই একতলা ডুবে যায়। ভাসছিল দোতলাও। একটু বাদে গোটা বাড়িটাই খেলনার মতো উপড়ে নিয়ে যায় মন্দাকিনী। সবাইকে বার করে নদীর সঙ্গে চলে গিয়েছেন মহারাজ।
ঝাঁপিয়ে মাটিতে পড়ার আগেই কারা যেন লুফে নিয়েছিল। কাদায় ডুবে যাওয়া এক-একটি জ্যান্ত মানুষকে টেনে তুলছে স্থানীয় যুবকেরাই। কাদা থেকে হিঁচড়ে টেনে তুলতে গিয়ে খসে পড়ছে পোশাক। আব্রু বাঁচাতে নুয়ে পড়ছেন মহিলারা। প্রতিমা তাঁর শাল এগিয়ে দিলেন। জ্যাকেট খুলে দিলেন ডাক্তারবাবু। তাঁর বন্ধু প্রতীপনারায়ণ দেব পড়ি-মরি করে বেরিয়েছিলেন খালি গায়েই। পড়ে থাকুক ব্যাগপত্তর-টাকাকড়ি। একমাত্র ডাক্তারবাবুর পায়ে হাওয়াই চটি। গঢ়বালের পাহাড়ে পাঁচ দিন ধরে সেটাই ট্রেকিং শু।
যমুনোত্রী বা কেদারে ঘোড়া কিংবা ডুলির জন্য আকুতির কথা ভাবলে হাসি পায় প্রতিমারও। বোল্ডারে ঢাকা পথটা প্রায় গুঁড়ি মেরে যেতে হবে বলে গোমুখ দর্শন বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু প্রাণের দায়ের কাছে হাঁটুর ব্যথা তুচ্ছ। অনেকটা চড়াই ভেঙে ‘দীপক লজে’ ঠাঁই মেলে। একতলার ঘর দেখলেও তখন আতঙ্ক হচ্ছে। তিন তলার এক গুজরাতি দম্পতি ঘর খুলে দিল। পরের দিন ভোরে প্রাণ নিয়ে গৌরীকুণ্ডের চুড়োর কাছাকাছি।
জনপদটির নাম গৌরীগাঁও! গুটিকয়েক বাড়ি, খোলা চাতালে ঠাসাঠাসি ভিড়। নরোত্তম দাস গোস্বামী তাঁর দরজা খুলে দিলেন। চিলতে ঘরে গোটা ভারতবর্ষ। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ঢুকছে দিল্লি, রাজস্থান, গুজরাত, কানপুর, আসানসোল...। কোই ছুট তো নেহি গয়া হ্যায় আপ কা? কেউ হারিয়ে যায়নি কথাটা বলতে লজ্জা করে প্রতিমার। দিল্লির চৈতন্য ভেবে পাচ্ছেন না দেড় বছরের বাচ্চাটাকে কী ভাবে সামলাবেন। আসানসোলের প্রবালের স্ত্রী তনিমা, ভরতপুরের তিন বৃদ্ধা, কানপুরের মহিলা সবাই মিলে ভোলানোর চেষ্টা করছেন মা-হারা শিশুটিকে। কেদারের পথে রামওয়াড়ায় চৈতন্য ও তাঁর স্ত্রী আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। মায়ের সঙ্গে ১০ বছরের ছেলেটা। কে জানে বেঁচে আছে কি না! আর এই খুদেটি বাবার সঙ্গে। রাতভর হেঁটে কী ভাবে যেন পৌঁছেছেন গৌরীগাঁওয়ে।
গোটা ভারতবর্ষ গান গাইছে, নার্সারি রাইম শোনাচ্ছে একটি শিশুকে ভোলাতে। একটা-আধটা বিস্কুট এগিয়ে দিচ্ছে। শিশুটি আধোবুলিতে বলে, ভজন সুনাও। দু’দিন বাদে থামে বৃষ্টি। হেলিকপ্টারের দেখা মেলে। ছুড়ে দেওয়া দু’দশটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল বিকোচ্ছে ২০০ টাকায়। দু’টো রুটির দামও তাই। এর পরে হেলিপ্যাডে নেমে দিনভর শবরীর প্রতীক্ষা। বাঁচবার আকুতিতে নৃশংস ধাক্কাধাক্কি। দু’দিনের চেষ্টায় মেয়েকে নিয়ে কপ্টারে উঠতে পেরেছিলেন প্রতিমা। আসানসোলের প্রবাল, রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী মুক্তেশানন্দকে নিয়ে শোনপ্রয়াগের পথ খুঁজতে বেরোন ডাক্তারবাবু। সেনাবাহিনীর দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে গর্জে ওঠা মন্দাকিনী পেরিয়ে যান।
প্রতিমার মনে হয়, মানুষের ভেতরের আলো-কালো এ ক’দিনে যা দেখেছি, গোটা জীবনে দেখা হয়নি তা। আশ্রয়দাতা নরোত্তম ঘরভর্তি অতিথির জন্য খিচুড়ির জোগাড় করছেন। কপ্টারে উঠতে গিয়ে হেলিপ্যাডে বৃদ্ধাকে মারধর করে তাড়াচ্ছে যুবতী। গোচরে কপ্টার নামতে দেবদূতের মতো এসেছিল অমর মল্লিক, ললিত মল্লিক। জিপ নিয়ে বিপন্নদের উদ্ধারে নেমেছেন দুই তরুণ ব্যবসায়ী। ধস নামা ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে মা-মেয়েকে তাঁরাই পৌঁছে দিলেন দেহরাদূন। সারা রাস্তা খাবার, জলের সংস্থানও তাঁদেরই। কানাকড়ি পয়সা নিলেন না কিছুতেই। এক দিন বাদে মিলিটারির গাড়িতে গুপ্তকাশী, ঘনসালি, হৃষীকেশ হয়ে পৌঁছন ডাক্তারবাবু।
গৌরীকুণ্ডে ভারত সেবাশ্রমের ঘর থেকে তোলা মন্দাকিনীর ভিডিও মেয়ের কম্পিউটারে দেখলে এখনও বুকটা কাঁপে। জানলার ঠিক নীচে ফুঁসছে নদী। তখনও ঘন সবুজ পাহাড়ের ঢাল। এক-একটা প্রকাণ্ড গাছ টুপটাপ ঝরে পড়ছিল। দু’দিন বাদে মোবাইলে তোলা ছবিটায় তাণ্ডবের ধ্বংসাবশেষ। কে যেন সবটুকু সবুজ, বাড়ি-ঘর, জীবন খুবলে নিয়েছে।
ডাক্তারবাবুর মনে হয়, বেঁচে আছি! পুজোর গন্ধ, ঢাকের বাদ্যি, শাঁখে পুনর্জন্মের স্বাদ।
ভরা ঘরে সবাইকে নিয়ে আরও ঘন হয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে।
শুভ শারদীয়া।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.