শতবর্ষ পেরিয়ে গিয়েছে পুজো। তবু নিয়মের যাঁতাকলে এখনও দেবীর ভোগ রান্না থেকে ব্রাত্য কাটোয়ার মল্লিকবাড়ির সদস্যেরা। পুজোর প্রতিষ্ঠাতা রাধিকাপ্রসাদ মল্লিকের তৈরি করা নিয়ম অনুযায়ী দেবীর ভোগ রান্না করেন ব্রাহ্মণেরা। এমনকী, পুজোর ফল কেটে দেবীর সামনে রাখেনও তাঁরাই। আর এই নিয়মের ব্যতিক্রম চান না পরিবারের এই প্রজন্মের সদস্যেরাও।
কাটোয়ার পঞ্চাননতলায় মল্লিকদের পুজো বাড়ি। সারা বছর কার্যত বন্ধ থাকে এই পুজোবাড়ির দরজা। পুজোর সময়ে দরজা খোলা হয়। বাড়ির মধ্যে বনেদিয়ানা স্পষ্ট। তবে আগের চেয়ে পুজোর জাঁকজমক অনেক কমেছে। ঝাড়বাতি এখন আর নেই। ঝাড়বাতির মতোই চুরি হয়ে গিয়েছে রুপোর হাতল দিয়ে তৈরি চামর। পুজোর পালা থাকায় এ বার আগেভাগে কলকাতা থেকে চলে এসেছেন মনোজিৎ মল্লিক। পেশায় চিকিৎসক মনোজিৎবাবু বলেন, “স্বপ্নাদেশে রাধিকাপ্রসাদবাবু পুজো শুরু করেন। তার পর থেকে পারিবারিক ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে।” বাড়ির সদস্যেরা জানান, ছোট কুঁড়েঘরে দেবীর আরাধনা শুরু হয়। ব্যবসা বাড়ার পরে পুজোবাড়ি তৈরি করেন রাধিকাপ্রসাদবাবু।
এই বাড়ির দোতলায় প্রতি জানলায় বাঁধা থাকে নারকেল ও কলা, যাকে ‘রচনা’ বলেন পরিবারের সদস্যেরা। কেন এই নিয়ম, তার কোনও ব্যাখ্যা অবশ্য তাঁরা দিতে পারেননি। নবমীর দিন আগে দরিদ্রনারায়ণের সেবার আয়োজন হলেও এখন সেই রেওয়াজ উঠে গিয়েছে। পুজোবাড়ির আনাচে-কানাচে খসে পড়ছে পলেস্তরা। |
একটি পরিবারের দু’টি দুর্গা। একটি আদি দুর্গা, একটি নতুন দুর্গা। মন্তেশ্বরের মালডাঙা বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া বাবুনপুর গ্রামের মণ্ডল পরিবারের এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা হলেন ঠাকুরদাস মণ্ডল। সে প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। পরবর্তী সময়ে এই পরিবারের সদস্যরা ছড়িয়ে পড়েন গ্রামের আনাচে কানাচে। ৮০ বছর আগে যাতাযাতের অসুবিধার কারণে পরিবারের সদস্যদের একাংশ শুরু করেন নতুন দুর্গাপুজো। তবে সেটি অন্য বাড়িতে। এই দুর্গাই পরিচিত ‘নবদুর্গা’ নামে। তবে যে শরিকরা নতুন দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন আদিদুর্গার পুজোর সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন তাঁরা। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি ১২ বছর অন্তর নবদুর্গা পুজোর শরিকদের আদিদুর্গা পুজো করতে হয়। সে বছর নবদুর্গার শুধু কাঠামো পুজো। এ বছর নতুন পুজোর শরিকদের আদিদুর্গার পালা পড়েছে। পরিবারের সদস্য তথা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক কাজল মণ্ডল বলেন, “একসঙ্গে দু’টি পুজো সমানভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই এ বছর আমরা নবদুর্গার কাঠামো পুজো করব।”
কালনা ২ ব্লকের পাতিলপাড়া গ্রামের সেনগুপ্ত পরিবারের মহালয়ার পর প্রতিপদ থেকে শুরু হয় দেবীর বোধন। টানা চলে চণ্ডীপাঠ থেকে আরতি। এই পুজো শুরু হয়েছিল ১২১০ বঙ্গাব্দে। এই পুজোর প্রতিমা একচালার। বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। নবমীতে হয় কুমারি পুজো। আগে পুজোর সময় সেনগুপ্ত বাড়িতে গোটা গ্রামের পাত পড়ত। অষ্টমীর দিন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হত লুচি ভোগ। বর্তমানে অবশ্য সেই রেওয়াজ ভেঙেছে। সেনগুপ্ত পরিবারের সদস্যেরা জানিয়েছেন, এই পুজো দেখতে এসেছিলেন চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার-সহ বহু বিশিষ্ট মানুষ।
বুদবুদের মানকরের বড় কবিরাজ বাড়ির পুজো প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের। বর্তমান সদস্য সুজিত দাশগুপ্ত জানান, বর্ধমান রাজার কাছে জমিদারি পাওয়ার পরে এখানে বাস শুরু করেন পূর্বপুরুষেরা। তখন থেকেই পুজো চলছে। আগে এখানে জাঁকজমকের সঙ্গে পুজো হত। এলাকার মানুষজন এখানে পুজোর চার দিন খাওয়াদাওয়া করত। কিন্তু এখন আপ সে সব হয় না। মানকরের বিশ্বাস বাড়ির পুজো এ বার ৩১২ বছরে পড়ল। বাড়ির সদস্য তপনকুমার বিশ্বাস জানান, তাঁদের পুজো হয় শাক্ত মতে। প্রতিমা হয় একচালার।
কাঁকসার ত্রিলোকচন্দ্রপুরের মণ্ডলবাড়ির পুজো প্রায় তিনশো বছর পুরনো। বাড়ির সদস্য গুরুদাস মণ্ডল জানান, পূর্বপুরুষ রামধন মণ্ডলকে একবার শ্বশুরবাড়িতে দুর্গাপুজো না করার জন্য ব্যঙ্গ করা হয়েছিল। গুরুদাসবাবু বলেন, “এর পরেই রামধনবাবু পুরী গিয়েছিলেন দুর্গা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এমনকী ঠাকুর প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত তিনি উপবাসে ছিলেন। সেখানে সমুদ্রে স্নান করিয়ে দুর্গা নিয়ে এসেছিলেন।” বংশের প্রবীণ সদস্য সাধনকুমার মণ্ডলের দাবি, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এখনও রামধনবাবুর নামে একটি স্বর্ণকলস রাখা আছে। নবমীর দিন গ্রামের বাইরে তিলুইচণ্ডী তলায় পুজো হয়। কথিত রয়েছে, সেই তিলুইচণ্ডী লক্ষ্মণ সেনের আমলের। নবমীর দিন কুমারীপুজো দেখতে আশপাশের গ্রামের মানুষ ভিড় জমান।
কাঁকসার গোপালপুরে বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো প্রায় তিনশো বছরের। এলাকায় তা হাকিমবাড়ির পুজো নামে পরিচিত। পরিবারের বর্তমান সদস্য প্রিয়নাথবাবু জানান, নিয়ম মেনে আজও শরিকি ভাগ না করে ভোগ রান্না করা হয় এক হাঁড়িতে। বৈষ্ণব মতে পুজো। একশো আট পদ্ম এবং অষ্টমীতে নীলপদ্ম লাগে। |