মিউজিক কন্ডাক্টর ডেভিড মার্ফির সঙ্গে পণ্ডিতজি কাজ শুরু করেছিলেন সেই অপেরার। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে অবধি এ নিয়ে কাজ করেছেন। সুর করেছেন পৃথিবীর প্রথম ‘ইস্ট ওয়েস্ট অপেরা’র। নাম রেখেছিলেন ‘সুকন্যা’।
|
ছবি সৌজন্য:
ডেভিড মার্ফি। |
আর সেই অপেরার কাজে শেষ টান দিচ্ছেন তাঁর কন্যা অনুষ্কাশঙ্কর। সঙ্গে ডেভিড আর লেখক অমিত চৌধুরী। আজ লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে ডেভিড, অমিত আর অনুষ্কা মিলে দেখাবেন কী ভাবে তাঁরা এই অপেরার কাজ শেষ করছেন।
লন্ডন থেকে টেলিফোনে ডেভিড বললেন, “জানেন, এই প্রজেক্টটা নিয়ে উনি কত বছর ধরে ভেবেছিলেন! প্রায় বছর পনেরো তো হবেই। বহু আর্কাইভাল মেটেরিয়াল আছে আমাদের সংগ্রহে। এটা একটা ‘স্ট্রেঞ্জ কোইনসিডেন্স’ যে মহাভারতের এই উপকাহিনির সঙ্গে উনি নিজের জীবনের একটা মিল খুঁজে পেয়েছিলেন।”
শেষের দিকে তো পণ্ডিতজি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখনও কি ওই অপেরা নিয়ে ভাবতেন তিনি? “হ্যাঁ, অবশ্যই। হাসপাতালে থাকার সময়ও অপেরার কাজ করেছেন। ওঁর সঙ্গীত চিন্তা এমনই ছিল যে সারাক্ষণ কিছু না কিছু নতুন ভাবনা বয়ে বেড়াতেন। সব সময় চলত তাঁর নতুনের জন্য খোঁজ। হাসপাতাল, অসুস্থতা এ সব ওঁকে আটকে রাখতে পারেনি। প্রথম প্রথম তো অনেক ঘণ্টা ধরে একসঙ্গে কাজ করতাম। শেষের দিকে সেটা কমে দিনে চার ঘণ্টা হয়েছিল!” বলছেন ডেভিড। এই কাজে সব থেকে যেটা বড় প্রাপ্তি হতে চলেছে, তা হল প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য এই দুই ঘরানার সঙ্গীতকে নিয়েই পণ্ডিত রবিশঙ্করের অপেরা কম্পোজ করা। “এমন কাজ এর আগে কখনও হয়নি। নানা রঙের সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ওয়েস্টার্ন মিউজিক যেমন আছে, ঠিক তেমন ভাবেই রয়েছে মার্গীয় সঙ্গীতের ছোঁয়া। বহু রাগের মধ্যে ইমন কল্যাণ রাগটিও অপেরাতে বারবার ফিরে এসেছে। এটা গ্রাউন্ডব্রেকিং একটা কাজ।”
|
“গুরুজি বলেছিলেন, নিজে যদি এই কাজটা শেষ না করে যেতে পারেন,
তা হলে যেন
অনুষ্কা তার ভার নেয়। কারণ অনুষ্কাই নাকি সঙ্গীত ভাবনায় ওঁর সব থেকে কাছের।”
সুকন্যাশঙ্কর |
|
সুকন্যা শুক্রবারের অনুষ্ঠানে যাবেন। বলছেন, “গুরুজির এই কাজটা এ ভাবে শেষ হচ্ছে দেখে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। রয়্যাল অপেরা হাউজ, কভেন্ট গার্ডেন, লন্ডন ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রা আর আর্টস কাউন্সিল ইংল্যান্ড মিলে কাজটা সম্পন্ন করা হবে। গুরুজির ইচ্ছে ছিল কাজটা নিজেই শেষ করার। কত বার দেখেছি ডেভিড হাসপাতালে ওঁর বিছানার পাশে বসে থাকত। আর গুরুজি বসে বসে অপেরার কাজ করে যেতেন।” একেই কি বলে প্রেম? নাকি সাধনা? হয়তো বা এক আশ্চর্য নিবেদনও। সুকন্যা বললেন, “গুরুজির উদ্দেশ্যই ছিল এমন একটা অভূতপূর্ব সৃষ্টি তিনি করবেন যাতে ভারত এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গীত-নৃত্য-নাটকের মেলবন্ধন ঘটাবেন নতুন এক ধারায়। আমাদের বলেছিলেন, নিজে যদি এই কাজটা শেষ না করে যেতে পারেন, তা হলে যেন অনুষ্কা তার ভার নেয়। কারণ অনুষ্কাই নাকি সঙ্গীত ভাবনায় ওঁর সব থেকে কাছের।” |
|
এই তো সে দিন: আলোচনায় মগ্ন পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও ডেভিড মার্ফি |
|
ডেভিড বলছেন, “অনুষ্কার মতো সহযোগী পেয়ে আমি খুশি। ও শুধু ভাল সেতার বাদকই নয়, সাঙ্ঘাতিক ভাল কম্পোজারও। অপেরাটিতে অনুষ্কার ভূমিকা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। আর অমিতও লিব্রেতো লেখার জন্য আদর্শ। গান বোঝে, লেখার হাতটাও ভাল।” কাজ শেষ হতে হতে ২০১৫। এখনও অবধি ঠিক আছে এর প্রথম পারফরম্যান্স হবে লন্ডনের ‘রয়্যাল অপেরা হাউস’-এ। তার পর সেটিকে ভারতেও আনার ইচ্ছে আছে ওঁদের।
আজ পণ্ডিতজিকে ছাড়াই শেষ হতে চলেছে অপেরার কাজ। কেমন লাগছে সুকন্যার? “গুরুজি সব সময় আমাকে রাগাতেন। বলতেন, আমার মা নাকি আমার ঠিক নামই দিয়েছিলেন। সুকন্যা। গুরুজি খুব চাইতেন একদিন না একদিন অপেরা ‘সুকন্যা’-কে দর্শকের সামনে নিয়ে আসতে,” বলছেন পণ্ডিতজির ছায়াসঙ্গী।
আর ডেভিড? আজও ভুলতে পারেন না সে দিনের কথা। পণ্ডিতজির চিরবিদায়ের পর যে দিন তিনি প্রথম ঠিক করেন এই অপেরার কাজ আবার শুরু করা যায়। এবং করতে হবে। বললেন, “নোটেশনের দিক দিয়েই ওঁর অনেক নির্দেশ আছে। কিন্তু সব চেয়ে অসুবিধে ছিল নিজেদের বোঝানো যে কাজটা আবার শুরু করা দরকার। ওঁর শারীরিক উপস্থিতি আর আমাদের মধ্যে নেই, তবে ওঁর সঙ্গীতের মূছর্র্নার মধ্যে আজও উনি ভীষণ ভাবে জীবন্ত।” |