বিড়িতে একটা লম্বা টান। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রবীণ প্রতিমাশিল্পী বললেন, “হয়তো মহাষষ্ঠীতে এমন কথা বলতে নেই। কিন্তু এটাই সত্যি। ষষ্ঠীর দিন সারা পৃথিবীতে যখন বোধনের বাজনা, আমাদের পাড়ায় তখন বিসর্জন।” ষষ্ঠীর দুপুরে কুমোরটুলির গলি-ঘুপচি যেন ভাঙা হাট। সুনসান, নিঃশব্দ। শিল্পীদের স্টুডিও ফাঁকা। আলস্যে আড়মোড়া ভাঙছে গোটা পোটোপাড়া।
আসলে কুমোরটুলিতে পুজো শুরু শ্রাবণ মাসে। ঠাকুরের কাঠামোয় মাটি পড়তে শুরু করে সে সময় থেকেই। প্রথমে মাটি, তার পরে তা শুকিয়ে রং আর সাজ। শেষে চক্ষুদান। তার মধ্যেই চলে বর্ষার সঙ্গে লাগাতার যুদ্ধ। বৃষ্টি যত বেশি হয়, সময়মতো কাজ শেষ করতে ততই বাড়ে রাত জাগার পালা। শিল্পী সুস্মিতা পাল, রামচন্দ্র পালদের কথায়, “এখন তো শ্রাবণ মাসের আগে থেকেই আমাদের কাজ শুরু করে দিতে হয়। যা বৃষ্টি। এ বার শেষ দিকে বর্ষা খুব ভুগিয়েছে, জানেন। মনে হচ্ছিল, কাজ বোধহয় আর শেষই করতে পারব না। এখনও আমার কারিগরেরা অনেক মণ্ডপে শেষ মুহূর্তের কাজ করছেন।”
এর সঙ্গে বাইরের ঝামেলাও কম নয়। সেই শ্রাবণ মাস থেকেই শুরু হয়ে যায় দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের আনাগোনা। তার সঙ্গে পেশাদার আর অপেশাদার ক্যামেরাম্যানের ভিড়। সরু সরু গলিতে পা রাখাই দায়। মহালয়ার দু’তিন দিন আগে থেকে ভিড় বাড়তে থাকে কুমোরটুলিতে। ঠাকুর নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। ভিড়ের চোটে প্রতিমা বোঝাই ট্রাক এলাকা থেকে বার করাই মুশকিল হয় পুজো কমিটিগুলির। পঞ্চমীর ভোর পর্যন্ত এই ব্যস্ততা চলেছে। ছ’টার পরে ঘুমোতে গিয়েছে কুমোরটুলি। |
প্রতিমা চলে গিয়েছে প্যান্ডেলে। তাই খাঁ খাঁ করছে কুমোরটুলি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক। |
এত দিন যত্ন করে সাজানো মূর্তি ষষ্ঠীর দুপুরে চলে যাওয়ায় মনখারাপ আর দীর্ঘ কাজের ক্লান্তি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে কুমোরটুলিকে। সঙ্গে হাতে এসেছে অনেকটা অবসর। মহিলা শিল্পীরা অনেক দিন পরে নিজের হাতে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছেন। পুরুষ শিল্পীদের অনেকে আবার দু’গাল ভাত খেয়ে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছেন।
তবে এই বিশ্রাম শুধু ষষ্ঠীর বিকেল পর্যন্তই। তার পরে আবার কাজ শুরু। এ বার লক্ষ্মী আর কালী। কারিগর প্রসেনজিৎ ঘোষের কথায়, “ষষ্ঠীতেই আমাদের দুর্গাপুজো শেষ। কিন্তু সপ্তমী থেকে পুরোদমে শুরু হয়ে যায় লক্ষ্মীপুজো আর কালীপুজো। তার পরে আবার জগদ্ধাত্রী আছেন।”
মায়ারানি পাল ছ’বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে ঠাকুর গড়ছেন। এই তিয়াত্তরেও ষষ্ঠী এলে মন খারাপ হয়ে যায়। বললেন, “শেষ এক মাস ধরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করতে হয়। চার দিকে জমজমাট। ষষ্ঠীর দিনটা তাই খুব ফাঁকা লাগে। মনখারাপ হয়ে যায়। ষষ্ঠীর দিন বিকেলেই তাই লক্ষ্মী পেড়ে ফেলি।”
এ দিন থেকে নদিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদের মতো জেলা থেকে আসা অনেক কারিগর বাড়ি ফিরতে শুরু করেন। পুজোটা তাঁরা কাটান পরিবারের সঙ্গেই। তবে শ্যামসুন্দরদের সেই সুযোগও নেই। “১৫-২০ দিন ধরে রাত জাগা চলেছে। আজ ঘুমোব। কাল বাড়ি ফিরব” বলছিলেন শ্যামসুন্দর। ঠাকুর দেখবেন না? একগাল হাসেন শ্যামসুন্দর। বলেন, “আমাদের আবার ঠাকুর দেখা। ছুটিতে গিয়ে গ্রামে বাবার সঙ্গে ঠাকুর গড়ায় হাত লাগাব। লক্ষ্মীপুজো-কালীপুজো কাটিয়ে ফিরব। এখানে এসে আবার জগদ্ধাত্রী তৈরি করব।”
ষষ্ঠীর সন্ধ্যা গড়িয়ে আসে। শহর ভাসছে এলইডি-র আলোয়। কুমোরটুলিতে মাটির গন্ধ মাখা অন্ধকার ঘরগুলিতে পড়ে রয়েছে বিক্রি না-হওয়া দুর্গা প্রতিমা। অপেক্ষা, সামনের বছর কোনও মণ্ডপ আলো করে বসার। |