হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস কিনতে চেয়ে যে দর দিয়েছে ইন্ডিয়ান অয়েল (আইওসি), তাতে খুশি রাজ্য সরকার। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, আইওসি-র দেওয়া দরে রাজ্য সরকারের শেয়ার যদি চ্যাটার্জি গোষ্ঠী কিনতে রাজি না-হয়, তা হলে ওই শেয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাকেই বিক্রি করে দেওয়া হবে।
আইওসি শেয়ার-পিছু কত দর দিয়েছে, তা অবশ্য এ দিন জানাননি শিল্পমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “নিলামের পরামর্শদাতা সংস্থা ডেলয়েট যে ন্যূনতম দর (রিজার্ভ প্রাইস) নির্ধারণ করেছে, তার থেকে অনেক বেশি দাম দিতে চেয়েছে ইন্ডিয়ান অয়েল। তবে নিয়মকানুনের কারণে সেই দাম জানানো সম্ভব নয়।” আইওসি-র পেট্রোকেম বিজনেস ডিভিশনের এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর সিদ্ধার্থ মিত্রও ফোনে জানান, দর সম্পর্কে কোনও তথ্যই তাঁরা প্রকাশ করতে পারবেন না। কারণ, তা প্রথম জানার অধিকার চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর। ন্যূনতম দরও তাঁদের জানানো হয়নি বলে দাবি করেন সিদ্ধার্থবাবু। চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কেউ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্ট একটি অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, রিজার্ভ প্রাইসের তুলনায় ৪৫ শতাংশ থেকে ৫২ শতাংশ বেশি দাম দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে আইওসি। ফলে পেট্রোকেমের শেয়ার বেচে প্রায় ২৩০০ কোটি টাকা রোজগারের আশা করছে রাজ্য।
গত সোমবার পেট্রোকেমের নিলামে দরপত্র জমা দিয়েছিল একমাত্র আইওসি। সে দিনই সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আইনি দিক খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীগোষ্ঠীর বৈঠকের পরে ১০ তারিখের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের দফতরে বৈঠক করেন মন্ত্রিগোষ্ঠীর চার সদস্য শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। আলোচনায় বসেন ইন্ডিয়ান অয়েলের পদস্থ আধিকারিক ও নিলামে পরামর্শদাতা সংস্থা ডেলয়েটের প্রতিনিধিরাও। প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন পার্থবাবু।
রাজ্য সরকার যে ৬৭.৫০ কোটি ইক্যুইটি শেয়ার বিক্রি করতে চাইছে, তার মধ্যে ১৫.৫০ কোটি শেয়ার বিতর্কিত। চ্যাটার্জি গোষ্ঠীও এই শেয়ারের দাবিদার। এবং তা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। ফলে চ্যাটার্জি গোষ্ঠী যদি আইওসি-র দেওয়া দরে সরকারের শেয়ার কিনতে রাজি না-হয়, তা হলে পেট্রোকেমের রাশ শেষ পর্যন্ত কার হাতে যাবে, তা নির্ভর করছে আদালতের রায়ের উপর। রায় যদি চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর বিপক্ষে যায়, (অর্থাৎ বিতর্কিত ১৫.৫০ কোটি শেয়ার তাদের হাতে না-আসে) তা হলে আজকের অঙ্কে ৬২.১৫% মালিকানা পেয়ে আইওসি-ই হবে পেট্রোকেমের একচ্ছত্র অধিপতি। আর চ্যাটার্জি গোষ্ঠী জিতলে, ৫৫% মালিকানা নিয়ে সংস্থার রাশ তাদের কব্জায় চলে যাবে। বস্তুত, ভোটের পরে কে মন্ত্রিসভা গড়বে, তা নিয়ে যেমন জল্পনা চলে, ঠিক তেমনই কলকাতার শিল্পমহলেও এখন চর্চার বিষয় পেট্রোকেম। আলোচনার বিষয়বস্তু, আগামী দিনে কী কী পরিস্থিতি হতে পারে এবং তাতে সংস্থার রাশই বা কী ভাবে হাত বদল হতে পারে।
সম্ভাবনা এক: যদি রাজ্যের সব শেয়ার আইওসি-র হাতে যায়।
এই মুহূর্তে আইওসি-র হাতে রয়েছে ১৫ কোটি ইক্যুইটি শেয়ার। শিল্পোন্নয়ন নিগমের ৬৭.৫০ কোটি ইক্যুইটি শেয়ারের বাইরেও বিভিন্ন রাজ্য সরকারি সংস্থার হাতে ২৭.১০ কোটি প্রেফারেন্স শেয়ার রয়েছে। এই শেয়ারও আইওসি-কে বিক্রি করে দিতে চায় রাজ্য। এমনিতে প্রেফারেন্স শেয়ারের মালিকের ভোট দেওয়ার অধিকার থাকে না। সংস্থার মালিকানা নির্ধারিত হয় কার হাতে কত ইক্যুইটি শেয়ার আছে, তা দিয়ে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থা যদি তিন বছরের উপর ডিভিডেন্ড না-দেয়, তা হলে প্রেফারেন্স শেয়ারের মালিকেরও ভোট দেওয়ার অধিকার জন্মায়। বেতন দিতেই কালঘাম ছুটে যাওয়া পেট্রোকেম প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই প্রেফারেন্স শেয়ারে ডিভিডেন্ড দেয়নি। ফলে এই শেয়ারের জোরেই পেট্রোকেমের মালিকানা যুদ্ধে এত দিন কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পেরেছিল রাজ্য সরকার।
এ বার সব শেয়ার আইওসি-র হাতে এলে পেট্রোকেমে তাদের মালিকানার পরিমাণ হবে ৬২.১৫%। অন্য দিকে, চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর হাতে এখন আছে ৬৬.৭৪ কোটি ইক্যুইটি শেয়ার। প্রেফারেন্স শেয়ার ধরে মালিকানার পরিমাণ ৩৭.৮৫%।
সম্ভাবনা দুই: চ্যাটার্জি গোষ্ঠী আইওসি-র দেওয়া দর মেনে সরকারের শেয়ার কিনে নিল।
সে ক্ষেত্রে পেট্রোকেমের প্রায় সম্পূর্ণ মালিকানাই তাদের হাতে চলে যাবে।
সম্ভাবনা তিন: বিতর্কিত শেয়ার চ্যার্টাজি গোষ্ঠীর বলে রায় দিল আদালত। বাকি ইক্যুইটি শেয়ার ও প্রেফারেন্স শেয়ার আইওসি-কে বেচল রাজ্য।
সে ক্ষেত্রে পেট্রোকেমে আইওসি-র মালিকানার পরিমাণ হবে ৫৩.৩৬%। অর্থাৎ রাশ তাদেরই হাতে।
সম্ভাবনা চার: বিতর্কিত শেয়ার চ্যার্টাজি গোষ্ঠীর বলে রায় দিল আদালত। আর সংস্থা ডিভিডেন্ড দেওয়ায় প্রেফারেন্স শেয়ারের ভোটাধিকার আর রইল না।
এ ক্ষেত্রে চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর মালিকানা দাঁড়াবে ৫৫ শতাংশের একটু বেশি। আইওসি-র প্রায় ৪৫%।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত অঙ্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কেউই এখন বলতে পারছেন না। কারণ, পেট্রোকেমের মালিকানা সংক্রান্ত নিয়ম অনুসারে নিলামে সর্বোচ্চ যে দর উঠবে, সেই দামে শেয়ার কেনার প্রথম সুযোগ দিতে হবে চ্যাটার্জি গোষ্ঠীকে। পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ফার্স্ট রাইট অব রিফিউজাল। হ্যাঁ বা না বলার জন্য এক মাস সময় পাবে তারা।
চ্যাটার্জি গোষ্ঠী যদি না বলে, তার পরেও শেয়ার হাতবদল হতে সময় লাগবে প্রায় সাত মাস। কারণ, তখন আইওসি-কে প্রতিযোগিতা (কম্পিটিশন) কমিশনের অনুমতি নিতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী যে সংস্থা শেয়ার কিনছে, আর যে সংস্থার শেয়ার কেনা হচ্ছে, তাদের যৌথ সম্পদ যদি ১০০ কোটি টাকা পেরিয়ে যায় এবং উৎপাদন মূল্য ৩০০০ কোটি টাকার উপরে হয়, তা হলে কমিশনের কাছে প্রমাণ করতে হবে যে, এই লেনদেন অন্য প্রতিযোগী সংস্থার ব্যবসার পথে অন্যায্য কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না। সেই কাজে সময় লাগে সাত মাসের মতো।
ফলে পেট্রোকেম-জটিলতার একটা অঙ্কে বৃহস্পতিবার যবনিকা পড়ল ঠিকই। নাটক কিন্তু এখনও বাকি। |