দেবীপক্ষে আলো দেবে কি দানের চোখ, হত্যে দিয়ে অপেক্ষা
তিন বছরের নিম্মি। ১২ বছরের তবসুম। ১৭-র অনন্ত। ১৫-র তুলি। ৩৮ বছরের ভারতী। ‘ওয়েটিং লিস্ট’-এর এক-একটা নাম। কেউ ছ’মাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি। কেউ বা চার মাস। সকলেই অপেক্ষায় রয়েছেন কখন দান করা একটা চোখ এসে পৌঁছবে হাসপাতালে।
চোখ আসে মাঝেমধ্যে। সেই খবর পাওয়া মাত্র হাসপাতালের আই ব্যাঙ্কের সামনে হামলে পড়ে ভিড়। কার বরাতে জুটবে সেই চোখ, তা নিয়ে চলে জল্পনা। কেউ এক জন সেটা পান।
ম্লান হয়ে যায় বাকিদের মুখ। হতাশার সেই বিন্দু থেকে ফের শুরু হয় তাঁদের প্রতীক্ষা।
কলকাতার রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথালমোলজি (আরআইও)-তে বুধবার সকালে এমনই ভিড় হয়েছিল। কেরাটোপ্ল্যাস্টি বা কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের জন্য। চক্ষু ব্যাঙ্কে কোনও মৃত ব্যক্তির চোখ পৌঁছচ্ছে এমন খবর পেয়ে তড়িঘড়ি ওয়ার্ড থেকে এসে চিকিৎসকের ঘরের সামনে ভিড় জমিয়েছিলেন অনেকেই। সকলেই জানতে চাইছিলেন, চোখ যদি সত্যিই আসে, তা পাবে কোন ভাগ্যবান?
আরআইও-র শিক্ষক-চিকিৎসক হিমাদ্রি দত্ত জানালেন, প্রতি বারেই পুজোর সময় চোখ দানের হার কিছুটা বেড়ে যায়। তাই অন্য ওয়ার্ডে রোগীর ভিড় কমতে শুরু করলেও চোখের ওয়ার্ড মোটেই খালি হয় না।
বিশেষ করে পুজোতেই যে মৃত্যুর হার রাতারাতি বেড়ে যায়, তা তো নয়! তা হলে এই সময়ে চোখ দানের হার বাড়ছে কী ভাবে?
চোখের অপেক্ষায় হাসপাতালে। —নিজস্ব চিত্র।
হিমাদ্রিবাবু জানান, অনেকে নিজের চোখ দানের ইচ্ছাপত্রে সই করে গেলেও মৃত্যুর পরে পরিবারের লোকেরা তা মানতে চান না। ওই চক্ষু-চিকিৎসক বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, যে-কোনও কারণেই হোক, পুজোর সময় এই মানসিকতায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। মৃতের পরিবারের লোকেরা এই মরসুমে দানধ্যানে খানিকটা উৎসাহী হয়ে ওঠেন। আর তারই প্রতিফলন দেখা যায় হাসপাতালের চক্ষুদান সংক্রান্ত নথিপত্রে। প্রতি বারেই পুজোর চার দিনে অন্তত দু’তিনটে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করে থাকি আমরা। তাই রোগীদের ভর্তি রাখতেই হয়।”
পুজোর সময় চোখ দানের উৎসাহটা যে বাড়ে, তার প্রমাণ আছে বলে জানালেন চক্ষুদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমাজকর্মী ব্রজ রায়ও। তাঁর কথায়, “পুজোর সময় এই ধরনের দানধ্যানের ব্যাপারে মানুষের উৎসাহ থাকে। কিন্তু সেই উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে চোখ গ্রহণ করা এবং তা যথাযথ ব্যবহারের পরিকাঠামো থাকাও জরুরি। নইলে সব নিষ্ফল হয়ে যায়।”
তিন বছরের নিম্মির মা খুশবু বেগম এ দিন ডাক্তারদের কাছে জানতে চাইছিলেন, আগের বারের পুজোয় চক্ষু ব্যাঙ্কে ক’টা চোখ জমা পড়েছিল। চিকিৎসকেরা জানালেন, রেকর্ড ঘেঁটে বলতে হবে। কিন্তু তিনি এটা জানতে চাইছেন কেন?
খুশবু জানালেন, ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন, এর পরে চোখ এলে তাঁর মেয়ের বরাতেই সেটা জুটবে। সেই অনুযায়ী তাঁরা মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন। চোখ এল। প্রতিস্থাপনের আয়োজনও সারা। হঠাৎই মেয়েটা জ্বরে পড়ে গেল। ব্যস, অপারেশন থিয়েটারের দোরগোড়া থেকে তাকে ফিরিয়ে আনা হল। এখন তাঁরা পরের চোখটার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।
খুশবু বললেন, “মেয়েটা যখন হাতড়ে হাতড়ে এগোয়, ভাত ভেবে পাথরকুচি মুখে পোরে, আমার বুকের ভিতরটা গুঁড়িয়ে যায়। চার মাস ধরে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছি। কবে সুযোগ আসবে, জানি না। রোজ হত্যে দিয়ে পড়ে থাকি।”
নিম্মির মতো রোগীদের আগে থেকে ভর্তি রাখতে হয় কেন?
হিমাদ্রিবাবু বলেন, “মৃত্যুর চার ঘণ্টার মধ্যে চোখ তুলে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না-করলে সেটা নষ্ট হয়ে যায়। আই ব্যাঙ্কে চোখ সংরক্ষণ করে রাখা যায় ঠিকই। কিন্তু আমরা ঝুঁকি নিই না। এখানে অপেক্ষার তালিকাটা অত্যন্ত দীর্ঘ। তাই চোখ পাওয়া মাত্রই আমরা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করি।” সেই জন্য চোখ আসার সম্ভাবনায় আগে থেকে রোগীদের ভর্তি রাখতেই হয়।
চক্ষুদান আন্দোলন ক্রমে ক্রমে দানা বেঁধেছে এ রাজ্যেও। মৃত্যুর পরে চোখ দানের যুক্তি বুঝছেন সাধারণ মানুষ। সচেতনতা বাড়ছে। তা সত্ত্বেও অপেক্ষার তালিকাটা এত দীর্ঘ কেন?
আই ব্যাঙ্ক অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার সভাপতি সমর বসাকের ব্যাখ্যা, এটা ঠিকই যে, চোখ পাওয়ার জন্য অনেকে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করে আছেন। প্রয়াতের ইচ্ছা মেনে চোখ দেওয়ার মতো পরিবারেরও অভাব নেই। কিন্তু মাঝখানে রয়েছে পরিকাঠামোর সমস্যা। সমরবাবু বলেন, “মূলত পরিকাঠামোর অভাবেই দান করার পরেও অনেক চোখ নষ্ট হচ্ছে। সেটাই দুর্ভাগ্যের।”
আত্মীয়ের মৃত্যুর পরে চোখ দান করতে যাওয়া বহু পরিবারের অভিজ্ঞতা একই। সমরবাবু জানান, এ রাজ্যে মৃত্যুর পরে চোখ সদ্ব্যবহারের হার ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০টা চোখ সংগৃহীত হলে তার ৪৬টাই নষ্ট হয়।” এই অপচয় বন্ধ করা গেলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে অনেকটাই সামঞ্জস্য আসবে বলে চিকিৎসকেরা জানান।
অপচয় বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?
পরিকাঠামোর অভাব তো আছেই। সেই সঙ্গে যেটুকু ব্যবস্থা আছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না বলেও অভিযোগ। চোখের চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে দিল্লি, আমদাবাদ, হায়দরাবাদ এগিয়ে গিয়েছে। কারণ, ওই সব জায়গায় ডাক্তার থেকে শুরু করে অ্যাম্বুল্যান্স-চালক পর্যন্ত সকলের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা আছে। “এখানে তো তেমন কিছু নেই। তাই চোখের আশায় বসে থাকা ম্লান মুখের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে,” বললেন শৌভিকবাবু।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.