বেসরকারি হাসপাতালে গরিব রোগীদের নিখরচায় পরিষেবা দিতে আরও এক ধাপ এগোল রাজ্য সরকার। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য ভবনে বেশ কয়েকটি প্রথম সারির বেসরকারি হাসপাতালের কর্তাদের ডেকে বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ওই হাসপাতালগুলিতে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ‘ফ্রি বেড’ রাখার কথা ভাবা হয়েছে। ওই শয্যাগুলিতে কারা ভর্তি হবেন তা ঠিক করবে সরকার-ই। এবং ওই রোগীদের সমস্ত রকম চিকিৎসা, শারীরিক পরীক্ষা ও ওষুধ নিখরচায় দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবারের বৈঠকে সরকার জানিয়ে দিয়েছে, বাছাই করা হাসপাতালগুলিকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সরকারি ফর্ম পূরণ করে কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। সেই উত্তরের ভিত্তিতে হাসপাতালগুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করে কারা কত ‘ফ্রি বেড’ রাখবে তা ঠিক করে দেবে স্বাস্থ্য দফতর। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলির বক্তব্য, গরিবদের নিখরচায় চিকিৎসা করতে হলে বাকিদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা আরও মহার্ঘ হয়ে উঠবে। স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের পরিমাণও কমতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
গত মাসেই রাজ্যের ১১টি বেসরকারি হাসপাতালকে স্বাস্থ্য ভবনে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ওই হাসপাতালগুলি কারা সরকারের কাছ থেকে কী সুবিধা নিয়েছে এবং তার বদলে তারা গরিবদের চিকিৎসার জন্য কতটুকু কী করেছে, সেটা এক মাসের মধ্যে তাদের জানাতে বলা হয়েছিল। স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, এক মাস কেটে গেলেও একটি হাসপাতাল ছাড়া কেউ কোনও উত্তর দেয়নি। সুতরাং এ বার সরকার নিজেই হাসপাতালগুলির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কোন হাসপাতালে কত শয্যা গরিবদের জন্য রাখতে হবে, তা নির্দিষ্ট করতে চাইছে। ৩১ তারিখের পর এ ব্যাপারে সরকার খসড়া নীতি তৈরি করবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলি ওই খসড়ার উপরে তাদের মতামত দিতে পারবে।
ঠিক কী তথ্য সংগ্রহ করছে রাজ্য? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, কোন বেসরকারি হাসপাতালে কত শয্যা, বর্তমানে তাদের ‘ডিসকাউন্ট পলিসি’ রয়েছে কি না, কত শতাংশ শয্যায় গরিব রোগীদের নিখরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে বা আদৌ রয়েছে কি না, কোন মাপকাঠির ভিত্তিতে ‘গরিব রোগী’ চিহ্নিত করা হয় সেই সব তথ্য জানা হবে। তার পরের ধাপে হাসপাতালের মুনাফা ও সরকারের কাছ থেকে নেওয়া সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে তাদের বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে ‘ফ্রি বেড’ -এর পরিমাণ ও ছাড় নির্ধারণ করা হবে।
কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে সরকার এমন নিয়মনীতি চাপাচ্ছে কী করে? সরকারের যুক্তি, এই হাসপাতালগুলি তৈরির সময় সরকারের থেকে নানা সুবিধা পেয়েছে ও তার বদলে গরিব রোগীদের জন্য শয্যা বরাদ্দ রাখতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলই। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা বলছেন, গরিবদের জন্য ছাড় দেওয়ার বিষয়টি নতুন সংযোজন নয়। অনেক আগে থেকেই তা চালু হওয়ার কথা ছিল। বাম আমলে নজরদারির অভাবেই বেসরকারি হাসপাতালগুলি এত দিন হাত গুটিয়ে বসেছিল বলে তাঁদের দাবি।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, মূলত নয়ের দশকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে হাসপাতাল তৈরির জন্য প্রায় বিনামূল্যে জমি দিয়েছিল সরকার। তাদের অনেকের লাইসেন্স ফি-ও মকুব করে দেওয়া হয়। সরকারের সঙ্গে যৌথ ভাবে গবেষণা চালানোর অঙ্গীকার করে অনেক হাসপাতাল অনেক কম দামে বিদেশ থেকে সরঞ্জাম এনেছিল বলেও স্বাস্থ্য কর্তারা জানিয়েছেন। তখনই নিয়ম হয়েছিল, হাসপাতালগুলি গরিব রোগীদের জন্য শয্যা বরাদ্দ রাখবে। কত জন গরিব রোগীর চিকিৎসা ওই সব হাসপাতালে হচ্ছে, তার মাসিক রিপোর্ট স্বাস্থ্য ভবনে পাঠাতে হবে। কোনও কোনও হাসপাতালের পরিচালন কমিটিতে স্বাস্থ্য দফতরের এক জন প্রতিনিধিকেও রাখা হয়েছিল এ ব্যাপারে নজরদারি করার জন্য। কিন্তু কোনও নজরদারিই কার্যত হয়নি। এমনকী সরকারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি ভাঙলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা-ও নির্দিষ্ট করা হয়নি কখনও। স্বাস্থ্য কর্তারা জানাচ্ছেন, এ বার সেই নজরদারিরই একটা পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে সরকার। প্রাথমিক পর্যায়ে ১১টি হাসপাতালকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরে সুবিধাপ্রাপ্ত বাকি হাসপাতালও এর আওতায় আসবে।
স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, জমি দেওয়ার সময় বেশির ভাগ হাসপাতালের সঙ্গেই সরকারের চুক্তি ছিল, অন্তত ২৫% শয্যা বিপিএল তালিকাভুক্ত রোগীদের নিখরচায় চিকিৎসার জন্য থাকবে। সেই রোগী সরাসরি ওই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন, আবার কোনও সরকারি হাসপাতাল থেকে ‘রেফার’ হয়েও যেতে পারেন। কিন্তু প্রায় কোনও বেসরকারি হাসপাতালই এই চুক্তি মানেনি। এখন সরকার নিজে উদ্যোগী হয়ে গরিবদের জন্য শয্যা সংরক্ষিত করতে চলেছে। অবশ্য বেসরকারি হাসপাতালগুলি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বহু ক্ষেত্রেই একমত নয়।
কেন? বেসরকারি হাসপাতালগুলির বক্তব্য, হাতের নাগালেই আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পেয়ে রাজ্যের রোগীদের মুম্বই-চেন্নাই ছোটার প্রবণতা খানিকটা হলেও কমানো গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি তরফে এমন ফতোয়া জারি হলে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের আগে তাঁরা দু’বার ভাববেন। বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা বলেন, “ছাড় দেওয়া যেতেই পারে। হয়তো গরিবদের জন্য শয্যার ভাড়া কিছুটা কমানো হল। কিন্তু সব কিছুই ফ্রি করে দেওয়া অসম্ভব।” দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্তার বক্তব্য, “গরিবদের কতটা ছাড় দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে সরকার খানিকটা দিশা দেখাতেই পারে। কিন্তু গরিবদের যদি সম্পূর্ণ নিখরচায় চিকিৎসা করতে হয়, তা হলে বাকিদের জন্য পরিষেবা আরও মহার্ঘ হয়ে উঠবে। কারণ আমরাও দানছত্র খুলে বসিনি।” গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যবিমার অভাবের দিকটিও তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
অন্য দিকে মঙ্গলবারের বৈঠকে সরকারের তরফে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আলু-পটলের ব্যবসার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। চন্দ্রিমা সোজাসুজি বলেছেন, “সরকারের থেকে সুযোগ আদায়ের আগে এগুলো ভাবা উচিত ছিল। কম দামে জমি বা অন্যান্য ফি মকুব করা হবে আর গরিবদের গরিবদের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা দেওয়া হবে না, এটা আমরা চলতে দেব না।” এমনকী কোন কোন গরিব রোগী বেসরকারি হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসার সুযোগ পাবেন, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব সরকার নিজের হাতেই রাখছে। জানা গিয়েছে, তার মধ্যে বিপিএল তালিকাভুক্ত রোগী থেকে প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী, বা দুঃস্থ শিল্পী সকলেই থাকতে পারেন। রোগী গরিব কি না, তা নির্ধারণের ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া শংসাপত্রকেও একটি মাপকাঠি হিসেবে রাখার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলির দাবি, এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। একাধিক হাসপাতালের কর্তারই অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিরা ভোটব্যাঙ্ক রক্ষার তাগিদে স্বচ্ছল লোকজনকেও দারিদ্রসীমার নীচে বলে ঘোষণা করতে পারেন। অতীতে এমন অভিজ্ঞতাও তাঁদের রয়েছে বলে দাবি। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে চন্দ্রিমাদেবী বলেন, “জনপ্রতিনিধির শংসাপত্র অবশ্যই অন্যতম মাপকাঠি। কিন্তু সেটাই যে একমাত্র মাপকাঠি, তা তো বলা হয়নি। সকলের বক্তব্য জানার পরে মুখ্যমন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।”
|