প্রবন্ধ ২...
‘এই রইল আপনার চাকরি’
থাটা শুনে হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন নাথ-বউদি। রামলালবাজারের নাথদা পাড়ার কিছু ছেলেছোকরাকে নিয়ে শুরু করেছিলেন দুর্গাপুজো। সহযোগীও পেয়ে গেলেন। কসবা বোসপুকুর, তালবাগানের সঙ্গে এক সময় একই পংক্তিতে উঠে গেল নাথদার পুজো। এ সব করতে গিয়ে পুজোর নেশা যে কবে তাঁকে পেয়ে বসেছিল, বুঝতেই পারেননি। বুঝতে পারলেন অবসরের পরে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আঞ্চলিক কর্তা, বরাবর পুজোর ফান্ড জোগাড় করার দায়িত্ব বহন করেছেন। অবসরের পরে ফান্ড আসবে কোথা থেকে? পুজোপাগল নাথদা নাছোড়বান্দা। এক নির্মীয়মাণ সংস্থার পরামর্শদাতা হিসেবে পাড়ি দিলেন দক্ষিণ ভারতের এক ছোট্ট শহরে। বললেন, “ওরা যে টাকাটা দিচ্ছে তাতে সব খরচা মিটিয়ে পুজোর ফান্ডে একটা বড় টাকা দেওয়া যাবে, বুঝেছ!” নারকেল তেলের রান্না খেতে খেতে এক বার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু চাকরি ছাড়েননি। পুজোর দেড় মাস থাকতেন কলকাতায়।
এমনই হয়তো এখনও চলত। কিন্তু রাজ্যে পরিবর্তন এল। স্কুল কমিটি, কলেজ কমিটি, বাজার সমিতির সঙ্গে সঙ্গে ওই পুজোও হাতবদল হয়ে গেল। নাথদা চাকরি ছেড়ে চলে এলেন। কিন্তু বিপদ এল অন্য দিক থেকে। রাস্তার মোড়ে পুজোর হোর্ডিং দেখলে এখন অসুস্থ হতে শুরু করেন মানুষটি। সঙ্গী সরকারি কর্মী মজুমদারদের দুই ভাই, গুহ সাহেবদেরও একই অবস্থা। ছোট মজুমদারই শেষ পর্যন্ত একটা উপায় বের করলেন। অফিসের সহকর্মীদের জুটিয়ে শুরু করে দিলেন একটি পুজোর পুরস্কার। এখন পুজোর আগের এক মাস নাথদা দারুণ ব্যস্ত। আবেদনপত্র সংগ্রহ করা, পুজো কমিটির লোকেদের, বিচারকদের সব বুঝিয়ে দেওয়া, তার পরে শ্রেষ্ঠ পুজোর সন্ধানে বিচারকদের সঙ্গে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে চক্কর। পুজোর মধ্যেই থাকছেন তিনি। হার্টের ব্যামো, পেটের ব্যামো, মনের ব্যামো সব উধাও! প্রবীণ মানুষটি হাসতে হাসতে বলেন, “খুব ভাল আছি জানেন।”
গত কুড়ি বছর ধরে পুজোর লেখা লিখতে গিয়ে দেখেছি, পাড়ায় পাড়ায় নাথদাদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। কেউ বাজার থেকে টাকা ধার করে পুজোর পরে স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে ধার মিটিয়েছেন। কেউ বাড়ি তৈরির ব্যাঙ্কঋ
ণের টাকা ঢেলে দিয়েছেন পুজোয়। কেউ পাঁচ কাঠা জায়গা বাঁচিয়ে রেখেছেন স্রেফ পুজো হবে বলে। ওই জমি বিক্রি করলে পায়ের উপরে পা দিয়ে বসে থাকতে পারতেন। নিজেকে এবং উত্তরসূরিদের যে তিনি বঞ্চিত করেছেন, এমন খোঁটা ইদানীং মাঝেমধ্যেই শুনতে হয় বেহালার বন্দ্যোপাধ্যায়দাকে। কিছুটা বিব্রত কণ্ঠে বলেন, “ও সব লোকে বলে। পুজোটা যে প্রতি বছর হচ্ছে এটাই বড় কথা। কাউকে না কাউকে তো এই জায়গাটা দিতেই হত। না হলে পুজো হত কোথায়?”
হরিদেবপুরের বসুদের দুই ভাই পুজোর জন্য ‘যা খুশি’ বাজি ধরতে রাজি। ওঁদের পুজোয় কাজ করা এক শিল্পীর দুর্ঘটনা ঘটেছে। ছোট বসুর শিক্ষিকা স্ত্রীর বেতনের বারো হাজার টাকা নিয়ে ছুটলেন শিল্পীর বাড়ি, “আমাদের পুজোকে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন ওই শিল্পী। ওঁর জন্য এটুকু করব না?” বসুরা মনে করেন, “পুজো চার দিন-পাঁচ দিনের একটা উৎসব মাত্র নয়। বাঙালির এই উৎসব দায়বদ্ধতার জন্ম দেয়। শিল্পীর প্রতি, আমজনতার প্রতি। আমাদের পরিবার সেখানে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করলে খুব কিছু যায় আসে না।”
তেলেঙ্গাবাগানের দাসের কাছে অষ্টমীর দিনটাই কয়েক বছর ধরে দশমী। কোনও পুরস্কারই লাগছে না। প্রতি বার নবমীর সকালে ফোনটা আসে, “সামনের বছর থেকে আর পুজোয় নেই। ব্যবসার কয়েক লক্ষ টাকা ঢুকে গিয়েছে পুজোয়। কোমর ভেঙে গিয়েছে পুরো।” পরের বছর পয়লা বৈশাখ কাটতে না কাটতেই ফের ফোন, “কম রেটের কোনও শিল্পী সন্ধানে আছে নাকি দাদা?” ‘তবে যে বললি আর পুজোয় থাকবি না?’ জবাব আসে, “পাড়ার সবাই এমন ভাবে ধরল...” পাশের পাড়ার মণ্ডল, একাধারে দাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সহমর্মী। প্রতি বারই ব্যবসা থেকে পুজোয় টাকা ঢুকে যায় আর বছরের শেষে ব্যালান্স শিট মেলাতে হিমশিম অবস্থা। তবুও পুজো এলে নিজেকে সামলাতে পারেন না, “পুজো ছেড়ে থাকতে পারব না কাকু, মরে যাব।”
বেহালার শীতলাতলার ব্যাঙ্ককর্মী বসু একটি বড় পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে সরে এসে নিজের পাড়ায় একটি ছোট পুজোর দায়িত্ব নিয়ে গোটা পাড়ার পরিবেশটাই বদলে দিয়েছেন। “এখানে আমাদের সব ছেলেরা, বাড়ির মেয়ে-বউরা হাতে হাত লাগিয়ে পুজোর কাজ করেন। মণ্ডপ যে সব উপকরণ দিয়ে তৈরি হয় তা তৈরি হয় আমাদের পাড়াতেই।”
প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের রায়দা পদোন্নতির সময় এলেই চাকরি বদল করেন। না হলে ট্রান্সফার নিতে হবে, তা হলে পাড়ার পুজো? রায়বউদি রেগে আগুন, “এ ভাবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কোনও মানে হয়? পরিবারের দিকে এক বার তাকাবে না?” রায়দা হাসেন, “পুজো এখন চার দিনের উৎসব নয়। সারা বছর তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। আর কাউকে তো একটা সেই দায়িত্ব নিতেই হবে।”
আর টালার ভট্টাচার্য? এ বছরই কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বরে বদলি হয়েছিলেন বছর তিরিশের এই যুবক। পুজোর আগে মাস দেড়েকের ছুটি চেয়েছিলেন। কিন্তু পনেরো দিনের বেশি ছুটি দেয়নি তাঁর সংস্থা। তাই চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন। পাড়ায়, বাজারে, আত্মীয়-বন্ধু মহলে যে-ই কিছু বলতে আসে, তাঁর এক কথা, “বললেই হল পুজোয় ছুটি দেবে না? আমার মনটা পড়ে থাকবে এখানে। আর ওখানে মন দিয়ে কাজ করব কী ভাবে? তাই ছেড়ে দিলাম।” স্ত্রী চাকরি করেন। সেই জোরেই যে এমন সাহস তিনি পেয়েছেন তা অস্বীকার করেননি ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, “একটা চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরি পাব। কিন্তু পুজোর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে না রাখলে বছরের বাকি সময়টায় লড়াই করার শক্তিটাই যে পাব না!”
লোকেশের দাদু কলকাতার পুজোয় এক বিরল চরিত্র। অবাঙালি ভদ্রলোক চান তাঁর বাড়ির উল্টো দিকের বিশাল মাঠে যে পুজোটা হয় তাতে যেন রোজ লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী আসেন। নিজের বাড়ির বিশাল চত্বর তিনি খুলে দিয়েছেন পুজো কমিটির জন্য। সেখানে পুজোর পাঁচ দিন পঞ্চব্যঞ্জন রান্না হয়। নবদ্বীপ থেকে ঠাকুর আসে। নিজের ছোট্ট ঘরে বসে সব কিছু তদারক করেন তিনি। বয়েস এখন আশি। কলকাতার পুজো নিয়ে, পুজোর কলকাতা নিয়ে, গর্ব করব না?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.