প্রবন্ধ ১...
কোন আশ্বিনে আসবে ঘরের দুর্গতিনাশিনী
ছোটবেলা থেকেই দুর্গা ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে অসুরের মূর্তির দিকেও কম নজর দিইনি। কেমন হল অসুর? বেশ ভয়াবহ না হলে মনে ধরে না, তা হলে আর কার্তিক ঠাকুরের সঙ্গে তফাত রইল কী! অসুর এক বহিরাগত দস্যু, কার্তিক ঘরের রক্ষক। অসুর সেই বাইরের অশুভ পুরুষেরা, সেই কামদুনির ধর্ষকরা যারা একটি মেয়েকে শিকার বানাবে বলে ফাঁকা রাস্তায় ওত পেতে থাকে। সেই অন্ধকার পথের অচেনা-অজানা পুরুষেরা যাদের আমরা চিরকাল জেনেছি ভয় পেতে, সমঝে চলতে, রাস্তা আটকে থাকলে পথটাকেই বদলে ফেলতে। দৈবাৎ মুখোমুখি হয়ে পড়লে দ্রুত হেঁটে পথটুকু শেষ করতে যাতে তাদের চোখে চোখ না পড়ে। অসুর তারাই, যাদের জন্য অনেক মেয়ের পড়াশোনা, গান-নাচ-আবৃত্তি শেখা, টিউশন পড়তে যাওয়া, সাইকেল চালিয়ে হাইওয়ে দিয়ে যাওয়া, সব কিছু ছাড়তে হয়, এমনকী ছাড়তে হয় জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজন চাকরিবাকরি, রান্নার কাজ, সেলাইয়ের কাজ, সব। ছাড়তে হয় আনন্দ, বিশ্বাস। যাদের জন্য নিজের জীবনের সব খুশি-আনন্দ আর প্রয়োজনগুলোকে ত্যাগ করতে হয়, তারাই তো অসুর।
কিন্তু যারা আমাদের অনেক কিছু ‘হয়ে’ উঠতে দেয় না, তারা কি শুধুই পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অচেনা লোক? আমাদের নিজেদের বাড়ির লোকেরা, ঘরের কার্তিকেরা? যারা সেই পথের লোকের মতোই আচরণ করে আমাদের সঙ্গে, অনেক কিছু হয়ে উঠতে দেয় না পরিবারের সম্মানের নামে, তারা কি ভোলা শিব? সত্যিই? তাও তো বাদ থাকল ঘরের চার দেওয়ালের আড়ালে কার্তিকদের শরীরী আক্রমণ। আমাদের তো শেখানো হয়েছে দেবী দুর্গা অসুর নিধন করেন, সেই অসুর হল পরিবারের বাইরের অচেনা, অজানা এক পুরুষ, যে আমাদের শরীরের দিকে লোভের হাত বাড়াবে। বাইরে-কে এই ভাবে ভয় পেয়ে আমরা কুঁকড়ে থাকব, জানব ঘর আমাদের নিরাপদ রাখবে, তাই নিরাপত্তার জন্যই আমরা যেন ঘরে থাকি। ঘরেই থাকি।
মেয়েরা এই জেনে বড় হয় যে ভয় মানে ফাঁকা রাস্তা, ভয় মানে অচেনা-অজানা পুরুষ, ভয় মানে শরীরের ওপর আক্রমণ। কিন্তু যে ভয় অহরহ বাসা বেঁধে থাকে আমাদের মনের চেতনে-অবচেতনে ভাল, আরও ভাল মেয়ে হয়ে ওঠার যে ইচ্ছে, আমাদের সুখ-আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে অন্যেরা আমাদের যেমনটি চায় তেমনটি হয়ে ওঠা? নয়তো পরিত্যাগের, খারাপ বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয়? ছোটদা চায় না আমি ওর বন্ধুর সঙ্গে কথা বলি, শুধু যেন চা-টা দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যাই। মেজদা চায় না আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়ি, অনেক দূরে পড়তে আর টিউশন নিতে যেতে হবে, কেউ নেই আমাকে নিয়ে যাওয়ার, আবার আমাকে একলাও ছাড়া হবে না। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শাশুড়ি মা চান না আমি সালোয়ার কামিজ পরি, তাই দিঘা বা দার্জিলিঙে এলেই শুধু... বড় জা চান না আমি রাতের রান্না না করে মিটিং করতে যাই, তাই বিয়ের পর আর আমার নাটক করা হয় না। বর চায় না আমি চাকরি করি, তাই বিয়ের পর থেকে ঘরে বসা, ওর ওপর নির্ভরশীল থাকলে ও নিশ্চিন্ত থাকে। খাপ পঞ্চায়েত তো এ সবই বলে, আলিগড় বা মণিপুরে ছাত্র সংসদ যখন মেয়েদের শালীনতা রক্ষার উপদেশ দেয়, সেই একই প্রচ্ছন্ন হুমকিই তো তার মধ্যে নিহিত থাকে। তা হলে? বাইরে-র খাপ পঞ্চায়েত বা ছাত্র সংগঠনদের আমরা তুলোধোনা করি, বাড়ির খাপ পঞ্চায়েত বা দারুল-উলুমদের জন্য কী বরাদ্দ করব? কী বাপের বাড়ি, কী শ্বশুরবাড়ি সব সময় ভাল মেয়ে হয়ে ওঠা, গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা, নয়তো বিচ্যুতি, নয়তো প্রচ্ছন্ন তিরস্কার আমরা ভয় পেলেও সেই অনুভূতিকে ভয় বলে স্বীকার করি না, কারণ ভয় মানে আমরা জানি ফাঁকা রাস্তায় অচেনা-অজানা পুরুষ।
অসুর মানে বাইরের শত্রু, তাকে নিধন করা দেবীর পক্ষে সহজ, কারণ সে দেবীর শরীরে এক লোভী পুরুষের চোখ নিয়ে তাকিয়েছিল। আমরা যদি চণ্ডীর দেবীনির্মাণের ব্যাখ্যা ধরি, নানা শক্তি সমন্বয়ে আজকের ভাষায় তিনি একটি বিশেষ কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বানানো যন্ত্র, এক জন নারীবেশী যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া কিছু নন। অসুরের মধ্যে পুরুষের তথাকথিত নারীশরীরের লোভ সঞ্জাত করেছিলেন পৌরাণিকরা। তাই দুর্গা নামের যুদ্ধাস্ত্রটি স্ত্রী রূপে শোভিত, এক পুরুষকে প্রলোভন দেখাবে বলেই। কিন্তু লৌকিক দুর্গা আমাদের ঘরের মেয়ে, চলতি তথাকথিত মেয়েলি সব বৈশিষ্ট্য তাঁর অধিকার। কিন্তু তিনিও বাড়িতে শিব ঠাকুরের সব অন্যায়, নিষ্কর্মা হয়ে থাকা, শ্বশুর অপমান করেছে বলে বাপের বাড়ি যেতে না দেওয়া এই সব কিছু দিয়েই তো ঘরের মেয়ের ইচ্ছেটুকুকে অস্বীকার করেন। আমরা শরীরী হত্যাকে হত্যা বলে স্বীকার করি, কিন্তু এই যে ইচ্ছেগুলোর হত্যা, পাছে কোনও বিরোধ হয়, সেই জন্য বার বার নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে, অন্যের ইচ্ছেপূরণকে শান্তিরক্ষার একমাত্র পথ ধরে যে আত্মরক্ষার ব্যবস্থাগুলো মেয়েরা করেন, সেগুলো তো কোনও বিচ্যুতি হিসেবে চিহ্নিত হয় না? যেমন দিল্লির নিরাপত্তা নিয়ে সমীক্ষায় মেহরৌলি, বদরপুর, মালভিয়ানগরের অল্পবয়সি মেয়েরা বলেছেন, তাঁরা নিয়মিত নিগ্রহের শিকার হলেও বাড়িতে বলেন না, বাড়িতে বললেই বেরনো বন্ধ। কষ্টে উপার্জিত স্বাধীনতা খোয়াতে চান না তাঁরা। সময় বদলে, বাস বদলে, পথ বদলে নানা ভাবে নিগ্রহ থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন। সহ্যের সীমা ছাড়ালে অবশেষে ঘটে থাকে পড়া বা কাজ বন্ধ। বাইরে অসুরদলনী দুর্গাকে নিজের ঘরে এ সব মেনে নিতে হয়, মেনে নিতে হয় অভাবী পরিবার, নিষ্কর্মা স্বামী, কিন্তু যাঁর নিজের সম্মান সম্পর্কে টনটনে জ্ঞান, যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে না ডাকলে বউ বাপের বাড়ি যেতে পারবে না। অনেকে বলবেন এটাই স্বাভাবিক, সেটাই স্বামীর অধিকার, বিয়ের পর স্বামীর সম্মান সবার আগে, বিয়ের আগে বাপের বাড়ির পরিবার বলবে মেয়ের চাওয়া-না চাওয়া নয়, পরিবারের সম্মান আগে, এটাই ‘স্বাভাবিক’। এই স্বাভাবিকত্বগুলোর সঙ্গেই মেয়েরা মেনে নেন, জেনে যান বাইরের অসুরদের মারা যায়, ঘরের অসুররা সতত আরাধ্য।
ঘর ও বাইরের তফাতটা যথাযথ বুঝতে আর বজায় রাখতে শিখলেই কি দুর্গা ভাল মেয়ে হবে? সে জন্য তার নিজস্বতা, তার চাওয়া-পাওয়াগুলো একটু, বা পুরোটাই, বিসর্জন দিলেও সেটা বঞ্চনা হবে না? ভাল মেয়ে হয়তো হবে, কিন্তু সত্যি দুর্গা হবে না। পুরুষের সৃষ্ট দুর্গারা বাইরের অসুরদের দলন করেন, ঘরের কার্তিকদের তোষণ করেন। আমাদের তো চাই ঘরে-বাইরের এক সম্পূর্ণ দুর্গা। কোন আশ্বিনে আসবে ঘরের দুর্গতিনাশিনী?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.