দেবালয়ের পূর্বে শৌচালয়, এই কথা বলিয়া নরেন্দ্র মোদী নিজের সম্মুখে, এবং নিজের দলের সম্মুখে এক কঠিন পরীক্ষা আনিয়া ফেলিলেন। যে কোনও ভাবাবেগের ভিত্তিতে পরিচালিত রাজনৈতিক আন্দোলনে ভাঙিবার ইচ্ছা বড় হইয়া ওঠে। কখনও তাহা বিধর্মীর আরাধনাগৃহ, কখনও প্রশাসনিক ভবন, কখনও সামরিক ঘাঁটি। কখনও বা আস্ত একটি জনপদই পুড়াইয়া ছাই করিয়া দিয়া, মানুষের প্রাণহানি করিয়া ক্ষমতা দখল করিবার পথ প্রশস্ত হইয়া যায়। তাই ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কখনও না কখনও সাম্প্রদায়িক অশান্তিতে, অনেক সময়েই দাঙ্গায় মদত দিয়াছে, এবং তাহা হইতে প্রত্যক্ষ ভাবে লাভবান হইয়াছে। আবেগের উত্তেজনায় ধ্বংসকারী মানুষটিকেই পরিত্রাতা বলিয়া দেখেন বহু মানুষ, তাহার নিকট নিরাপত্তা খোঁজেন, তাহাকে কল্পিত বিজয়ের গর্বোল্লাস কিংবা অতীতের কোনও লজ্জাজনক পরাজয়ের গ্লানিমুক্তির নায়ক বলিয়া মনে করেন। ধর্ম, ভাষা, বর্ণ কিংবা অপর কোনও পরিচিতি-চিহ্ন বহু মানুষকে একত্রে বাঁধিয়া রাখিয়াছে বলিয়া, তাহাদের অতীতস্মৃতি এক বলিয়া, দুই-একটি কথা কিংবা কাজে তাহাদের সকলেরই সমর্থন পাওয়া যাইতে পারে।
দরিদ্রতম মানুষটির দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটাইবার কাজ অনেক কঠিন। এক তো সেই প্রয়োজন কাহারও নজরেই পড়ে না। বিদেশে রাজনৈতিক দলগুলি বিদ্যালয়, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট কিংবা পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা লইয়া নির্বাচনী লড়াই করিয়া থাকে। আরও বেশি ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করিব, কিংবা আরও বেশি নার্স নিয়োগ করিব, এমন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের মুখ্য নির্বাচনগুলিতে শোনা গিয়াছে। এ দেশে ভোটের সভায় কেহ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেন, কেহ মন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। গরিবের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা, রোজগার নিরাপত্তার প্রকল্প যদি বা ঘোষণা হয়, তাহারও ঝোঁকটা মানুষকে প্রলুব্ধ করিবার দিকে, তাহাকে আকর্ষণ করিবার দিকে। সস্তায় খাবার সকলেই চায়, বাড়ির নিকট যথাযথ পারিশ্রমিকে কাজ পাইবার ইচ্ছাও সবারই আছে। কিন্তু শৌচাগার ব্যবহারের ইচ্ছা? বাস্তব ইহাই যে, গ্রামে অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন পরিবারও শৌচাগার ব্যবহার করে না অনভ্যাসের কারণে। ভারতে অর্ধেকের অধিক মানুষ খোলা আকাশের নীচে শৌচকর্ম সারিতেছেন। তাঁহাদের অনেকেরই ঘরে টেলিভিশন রহিয়াছে, মোবাইল ফোনও রহিয়াছে। কিন্তু শৌচাগার নাই। অথচ ভারতে অস্বাস্থ্য, অপুষ্টির একটি মূল কারণ শৌচাগার ব্যবহার না করা। শিশুদের অপুষ্টির মূলেও তাহাদের ঘন ঘন পেটের রোগে আক্রান্ত হইবার সমস্যাটিই দায়ী, বলিতেছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। অর্থাৎ অপুষ্টির কারণ কেবল খাদ্যাভাব ভাবিলে ভুল হইবে, শৌচাগারের অভাবও তাহার কারণ। ভারতে যে সর্বাধিক মানুষ খোলা মাঠে প্রাতঃকৃত্য সারিতেছে, তাহা বিশ্বের নিকট ভারতের মাথা নত করিতেছে। কিন্তু মানুষের কাছে শৌচাগার পৌঁছাইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের মনে তাহা ব্যবহার করিবার তাগিদও জন্মাইতে হইবে। এটাও নেতৃত্বেরই কাজ। কিন্তু অতি কঠিন কাজ। যাহা কেহ চায় না, অথচ যাহা অতি প্রয়োজন, তাহার উপর রাজনীতি যিনি করিতে পারেন, তিনিই প্রকৃত নেতা। জওহরলাল নেহরু বলিয়াছিলেন, বড় বাঁধই আধুনিক ভারতের মন্দির। আজ মোদী বলিতেছেন, মন্দিরেরও পূর্বে শৌচাগার। সাধু। সুযোগ পাইলে করিয়া দেখাইবেন তো? |